বাংলা সাহিত্যে নবী (সা.)-এর ভক্তি ও প্রেম অনন্তকাল ধরে ধ্বনিত হচ্ছে

অসত্যের অন্ধকার দূর করে চিরন্তন মহাসত্যের অভ্যুদয় ঘটেছিল প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভাগমনে। তাঁর আগমনে বিশ্ব পেয়েছিল আলো, শান্তি ও মুক্তির পথ। তিনি রাহমাতুল্লিল আলামিন বিশ্ব মানবতার শান্তির দূত।।শুধু ধর্মীয় জগতে নয়, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও নবীজীর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বাংলার সাহিত্য, যা বাঙালির প্রাণের উচ্চারণ, সেই সাহিত্যের ইতিহাসেও নবী (সা.)-এর ভক্তি ও প্রেম অনন্তকাল ধরে ধ্বনিত হয়ে আসছে।
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন পর্যায়েই নবীবন্দনার সূচনা ঘটে। বৌদ্ধকবি রামাই পণ্ডিত (১০০০–১০২০ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর কলিমা জাল্লাল-এ নবীজীকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। যদিও তিনি নবীকে হিন্দু দেবতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। যাহা আমাদের বিশ্বাসের সাথে যায় না ।তবুও স্পষ্ট যে নবীর নাম ও মাহাত্ম্য বাংলার সংস্কৃতির ভেতর প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল সেই সময়েই।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে মুসলিম কবিরা নবীবন্দনার অসাধারণ ধারা সৃষ্টি করেন। শাহ মুহাম্মদ সগীর তাঁর ইউসুফ-জোলায়খা গ্রন্থে নবী (সা.)-কে নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরেন। কবি জৈনুদ্দীনের রাসুল বিজয় কাব্যে নবীর বীরত্বময় রণচিত্র অনুপমভাবে আঁকা হয়। দৌলত কাজী, আলাওল প্রমুখ কবিদের কাব্যে নবীপ্রেম মিশেছে ভক্তিমূলক সৌন্দর্যে। নারী কবি নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী তাঁর রূপজালাল-এ নবীবন্দনা দিয়ে সূচনা করেছেন, যা প্রমাণ করে নারীকণ্ঠেও নবীপ্রেম অগাধ শ্রদ্ধা ও আবেগে রূপ নিয়েছিল।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও নবীপ্রেম নতুন প্রাণ পেয়েছে।মীর মশাররফ হোসেন তাঁর মৌলুদ শরিফ-এ নবীর সত্যতা ও মানবমুক্তির বার্তা তুলে ধরেছেন।ফররুখ আহমদ তাঁর সিরাজাম মুনিরা-য় নবীজীর আগমনকে যুগান্তকারী শক্তি হিসেবে চিত্রিত করেছেন।গোলাম মোস্তফার অসংখ্য নাত-ই-রাসুল আজও মাহফিলে ও মসজিদে উচ্চারিত হয়। কবি গোলাম মোস্তফার" বিশ্বনবী"গ্রন্থটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের হৃদয়ের স্থান করে নিয়েছে। যাহা তার এক অমর সৃষ্টি। আকরাম খা সাহেবের "মোস্তফা চরিত" আর একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
কিন্তু আধুনিক সাহিত্যে নবীপ্রেমের সবচেয়ে অনন্য উচ্ছ্বাস আমরা পাই কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় নবীপ্রেম সমুদ্রোসম। তাঁর কলমে নবীজী হয়ে ওঠেন আধ্যাত্মিক মুক্তির উৎস, শ্রেষ্ঠ মানব ও মানবতার ত্রাণকর্তা। তার কবিতা ও গানে তিনি প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে যেভাবে বর্ণনা করেছেন যেভাবে উপস্থাপন করেছেন একমাত্র ফারসি সাহিত্য ছাড়া বিশ্ব সাহিত্যের আর কোন কবি তার নবী ভক্তির সমকক্ষ নন।
এখানে তাঁর কিছু কবিতা উদ্ধৃত করা হলো, যাদ্বারা কবির নবীপ্রেমের গভীরতার সামান্য উপলব্ধি সম্ভব:
*
“তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে,/
মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে।/
যেন উষার কোলে রাঙা রবি দোলে॥”
*
“ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মদ, এল রে দুনিয়ায়,/
আয় রে সাগর আকাশ বাতাস, দেখবি যদি আয়॥”
*
“তৌহিদের মুর্শিদ আমার মুহাম্মদের নাম,/
ঐ নাম জপলেই বুঝতে পারি খোদাই কালাম॥”
*
“মুহাম্মদ নাম যতই জপি, ততই মধুর লাগে,/
নামে এত মধু থাকে, কে জানিত আগে॥”
*
“ইয়া মুহাম্মদ, বেহেশত হতে/
খোদায় পাওয়ার পথ দেখাও।/
এই দুনিয়ার দুঃখ থেকে/
এবার আমায় নাজাত দাও॥”
*
“এ কোনো মধুর শারাব দিলে আল-আরাবী সাকী,/
নেশায় হলাম দেওয়ানা যে, রঙিন হল আঁখি॥”
*
“ইসলামের ঐ সওদা লয়ে/
এল নবীন সওদাগর॥”
এই কবিতাগুলোয় নজরুল নবীপ্রেমকে কখনো আলোর উৎস, কখনো মুক্তির প্রতীক, আবার কখনো গভীর ভক্তি ও আবেগের মূর্ত প্রতীক করেছেন।
বাংলার মরমি সাধকরা নবীপ্রেমকে আত্মিক মুক্তির মূল হিসেবে মেনেছেন। তাঁদের মতে—
“রাসুলকে চিনলে পরে খোদা চিনা যায়।”
তাঁরা বিশ্বাস করেন, নবী ছাড়া আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়া সম্ভব নয়। লালন, হাসন রাজা প্রমুখ মরমি কবিরা তাঁদের গানে নবীপ্রেমকে মানবমুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নবীপ্রেম এক অবিচ্ছিন্ন ধারা। প্রাচীন রামাই পণ্ডিত থেকে শুরু করে মধ্যযুগের শাহ মুহাম্মদ সগীর দৌলত কাজী, আলাওল, আধুনিক যুগের মীর মশাররফ, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা এবং নজরুল ইসলাম—সকলেই নবীজীর প্রেমে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের সাহিত্যকীর্তি।
বিশেষত নজরুল ইসলাম নবীপ্রেমকে যে গভীরতায় প্রকাশ করেছেন, তা বাংলা সাহিত্যে এক অমর ধারা সৃষ্টি করেছে। তাঁর কবিতার প্রতিটি ছত্র নবীপ্রেমের আলোয় দীপ্ত, যা আজও বাঙালির হৃদয়ে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মুগ্ধতার সঙ্গে ধ্বনিত হয়।
অতএব বলা যায়, বাংলা সাহিত্য নবীপ্রেমে ধন্য, নবীবন্দনায় পবিত্র, আর প্রিয় নবী (সা.)-এর আলোকধারায় সমৃদ্ধ।
লেখক :
নোমান আল মানসুর
বার্মিংহাম
২৯ আগস্ট ২০২৫
মীর্জা ইকবাল

মন্তব্য করুন: