মফস্বলে যানজট; নেপথ্য ও নিরসনের বাস্তবতা
Post Top Ad

মফস্বলে যানজট; নেপথ্য ও নিরসনের বাস্তবতা

১১/০৭/২০২৫ ২২:০৯:৩১

প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না: ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

ঢাকা শহরের যানজটের গল্প শুনে এবং তার চিত্র দেখে দেখেই আমরা সবাই বড় হয়েছি। সেখানে যানজট যেন স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু ঢাকা শহর পেরিয়ে এখন বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে মফস্বলের শহর গুলোতেও যানজটের মাত্রা প্রকটরূপে বাড়তে দেখা যাচ্ছে। সিলেট হচ্ছে বিভাগীয় শহর। বিভাগীয় শহর হিশেবে যানজট কিছুটা হতেই পারে। তবুও গত পাঁচ বছর আগেও এখানে যানজটের তেমন একটা মাত্রা দেখিনি। মাঝে মধ্যে দেখা যেতো সপ্তাহের বিশেষ কিছু দিনে বা উৎসব আয়োজনের সময়ে। অথবা সর্বোচ্চ ব্যস্ততম এক/দুটি সড়কে যানজট দেখা যেতো। বর্তমানে যা হরমামেশাই দেখা যাচ্ছে যেকোনো সড়কে। করোনা কালের আগেও এই শহরে যানজটের এতোটা ভোগান্তি ছিল না। যা নিজের চোখেই অবলোকন করেছি। 


করোনা কালে যখন শহরের প্রধান প্রধান সড়ক গুলো জনমানবশূন্য তেমনি যানবাহনও তেমন চোখে পড়তো না। চারপাশে যখন শূন্যতা আর হাহাকার, তখন কিছুটা আফসোসের সুরে বলতাম, আমাদের চিরচেনা ব্যস্ত শহরটা আবার কবে দেখবো। সেটা ছিল একটা আশার আলোয় চেয়ে থাকা আফসোস, যেন শহরটা মহামারি কাটিয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠে। কিন্তু করোনা কালের পরপরই চোখে পড়ে ভিন্ন চিত্র। শহর ব্যস্ত হয়ে উঠে ঠিকই, কিন্তু ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত সড়ক গুলো হয়ে উঠেছে এখন ভোগান্তির আরেক নাম। এখন আর কোনো প্রধান বা নির্দিষ্ট সড়ক নয়, যে সড়ক দিয়েই যাওয়া হোক জ্যামের দেখা পেতেই হয়। ৩০ মিনিটের রাস্তায় এখন কমপক্ষে ১ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে বের হতে হচ্ছে। এমনকি সামনে এটা আরও বাড়তে পারে।


যানজটের এই প্রকট অবস্থা করোনা কালের পর অতিরিক্ত হলেও এর নেপথ্যের কারণ আরও আগে থেকেই। আগে যানজট এতোটা প্রকট না হলেও আঁচ করা যেতো আগামীতে যানজট কিরূপ ধারণ করতে পারে। এর উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারে অপরিকল্পিত নগরায়ন, যত্রতত্র গাড়ির স্টেশন গড়ে উঠা, যথেষ্ট পাবলিক পরিবহনের অনুপস্থিতি এবং সড়কে হকার দোকান গড়ে উঠা। এর পাশাপাশি আছে বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পার্কিং ব্যবস্থা না থাকা। এবং প্রধান সড়কের একেবারে পাশেই প্রতিষ্ঠান গুলো গড়ে তোলা। যেখানে গাড়ি প্রবেশ ও বাহির করতে গেলে দেখা যায় এইটুকু সময়ের মধ্যেই রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হয়ে যায়। তারই একটি উদাহরণ রিকাবীবাজর থেকে ওসমানী মেডিকেল রোড। তবে ওসমানী মেডিকেল একটি বড় প্রতিষ্ঠান হয়েও তার সামনে এতোটাও যানজট সৃষ্টি হয় না, যতোটা লক্ষ্য করা যায় পপুলার মেডিকেল ও আশেপাশের ডায়গনিস্টিক সেন্টার গুলোকে ঘিরে। কারণ, সেখানে একের পর এক ডায়গনিস্টিক সেন্টারের কারণে গাড়ির ভীড় জমে একটু বেশি। অথচ প্রতিটি ডায়গনিস্টিক সেন্টারে পার্কিং ব্যবস্থা নেই। যেটিতে আছে সেখানেও দেখা যায় পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা নেই, এমনকি গাড়ি ঘুরানোর জন্যেও ভালো ব্যবস্থা নেই। প্রধান সড়কেই গাড়ি ঘুরতে হয়। এতেই অন্যান্য গাড়িদের অপেক্ষার সারি পড়ে যানজট সৃষ্টি হয়। 


যদিও এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো পরিকল্পনা চোখে পড়ে না। এরপর যদি আসি বন্দর বাজার থেকে আম্বরখানা সড়কের চিত্রে। এটি শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। যান চলাচলের চাপ একটু বেশি। অথচ এখানে সড়কের দুপাশে হকার দোকান গুলোই অর্ধেক রাস্তা দখল করে রাখে। এই সমস্যা নিরসনে সিটি কর্পোরেশন হকারদের বসার জন্য অন্যত্র জায়গার ব্যস্ততা করে দিলেও দেখা যায় কদিন পর আবার তারা সড়কে ফিরে আসেন! এবং এখানকার বেশিরভাগ শপিং দোকানের কোনো পার্কিং ব্যবস্থা নেই। যার জন্যে সড়কেই গাড়ি পার্কিং করে লোকজন শপিং করতে যান। সুতরাং দোষ, দায় সবটা প্রশাসনের নয়, কিছুটা আমাদেরও। 


সিলেটে পাবলিক পরিবহণ বলতে সিএনজির পরিমাণের মাত্রাই বেশি। সিটি কর্পোরেশনের কয়েকটি বাস চালু থাকলেও সেগুলোর ব্যবহার এতো বেশি চোখে পড়ে না বা সব সড়কেও পাওয়া যায় না। পাবলিক পরিবহণের পরিবর্তে সড়কে দেখা যায় অসংখ্য ব্যক্তিগত পরিবহণ। সেগুলোও যানজট সৃষ্টির একটি কারণ। বিশেষ করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি হলে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানের সামনে অসংখ্য ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার) একজন/দুইজন শিক্ষার্থীকে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। এসময় রাস্তা প্রায় ব্লক হওয়ার উপক্রম। সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের। এছাড়া যানজটের আরও অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে যত্রতত্র সিএনজি/প্রাইভেট কার/মাইক্রো গাড়ির স্ট্যান্ড। এগুলোও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে আবার সন্ধ্যা হওয়া মাত্রই ছেড়ে দেওয়া হয় ভোলাগঞ্জ থেকে আগত পাথরের ট্রাক গুলো। আগে এসব ট্রাক ছাড়া হতো রাত আটটার পর, এবং নির্দিষ্ট একটি সড়কে। এখন সরজমিনে বিভিন্ন সড়কেই চলতে দেখা যায়। এসব ট্রাক যেমন যানজটের জন্য অন্যতম কারণ, তেমনি সড়কে অনিরাপত্তাও তখন বেড়ে যায়। এ কারণে সড়কে দুর্ঘটনাও বাড়ছে দিন দিন। বিষয়টি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।


এতোক্ষন বলছিলাম একটি বিভাগীয় শহরের যানজটের কথা। কিন্তু বর্তমানে বিভাগীয় শহর ছাড়িয়েও জেলা শহর অর্থাৎ মফস্বলের শহর গুলোতেও যানজটের খবরাখবর পাচ্ছি। তেমনি একটি উদাহরণ সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলা শহর। অন্যান্য জেলা শহরের তুলনায় সুনামগঞ্জ যদিও এতোটা উন্নয়নের ছোঁয়া পায়নি, তবু সেখানেও যানজটের চিত্র খবরের কাগজে উঠে আসছে। গত ২০ ডিসেম্বর স্থানীয় পত্রিকা 'দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরের' যানজট নিয়ে একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, 'তীব্র যানজট, দুর্ভোগ'। এবং দুই বছর আগে ২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের একই পত্রিকার এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, 'ছোট শহর বড় দুর্ভোগ'। এই ছোট শহরের বড় দুর্ভোগের নাম 'যানজট'। দুই বছর আগের প্রতিবেদনটির সারমর্ম এরকম, "যততত্র পার্কিংয়ের কারণে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ব্যস্ততম আলফাত স্কয়ার এলাকায় যানজট লেগেই থাকে। 


অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে অন্য গাড়ি চলাচলেও সমস্যা হয়। এছাড়াও সড়কে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠা—নামা করা এবং সড়কের উপর হকারদের অস্থায়ী দোকানপাট থাকায় প্রতিদিন এই সড়কে যানজট তীব্র হচ্ছে।" দুই বছর পরের প্রতিবেদনও একই সমস্যা বলবত আছে। সঙ্গে আরও কিছু সমস্যা ও যানজটের স্থান যোগ হয়েছে, "যানবাহনের চাপ সইতে পারছে না অপ্রশস্ত সড়ক। সড়কের পাশে গড়ে উঠা দোকানপাঠও যানবাহন চলাচলে ধীরগতির অন্যতম কারণ। .......বিশেষ করে শহরের আলফাত স্কয়ার এলাকা, কালীবাড়ি মোড়, পুরাতন বাসস্টেশন, উকিলপাড়া, ষোলঘর প্রভৃতি স্থানে অসহনীয় যানজট তৈরি হয়। এছাড়াও শহরজুড়ে চলছে ব্যাটারিচারিত ইজিবাইক ও রিক্সার দাপট। এইসব ব্যাটারিচালিত যান সড়কের যানজট বাড়াচ্ছে বেশি।" ছোট শহরের গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো পয়েন্টেই যানজটের চিত্র। সুতরাং দুই বছর আগেই সমস্যার চিত্র উঠে আসলেও তার কোনো প্রতিকার হয়নি। যানজট নিরসনে সরজমিনে কোনো পরিকল্পনাও চোখে পড়েনি। এমন অবস্থা এখন দেশের প্রায় সকল মফস্বল শহরেই। এমন যদি চলতে থাকে তাহলে হয়তো আর কিছু দিন পর মফস্বল ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও যানজটের চিত্র দেখতে হবে।


লেখক : কলাম লেখক ও সংগঠক


নীরব চাকলাদার

মন্তব্য করুন:

Post Bottom Ad
Sidebar Top Ad
Sidebar Botttom Ad