শেখ মুজিব ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

প্রথমেই বলে রাখি, একাত্তর পরবর্তী প্রসঙ্গে (৭২-৭৫) শেখ মুজিবকে চাইলে অস্বীকার করতে পারেন। তবে একাত্তর ও এর আগের মুজিবকে ইতিহাস থেকে কখনো মুছে ফেলে দিতে পারবেন না। চব্বিশের ছাত্র আন্দোলন থেকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের উৎখাত হলে, শেখ মুজিবকে নিয়ে সাধারণ মানুষের একটা অংশের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া, পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা নিজে। মুজিব যতটা যোগ্য ছিলেন তাঁকে তারচেয়েও বেশি যোগ্য দেখানোর চেষ্টা ও অতি বাড়াবাড়ির কারণে মানুষের মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যাক সেদিকে আপাতত আর যাচ্ছি না। চাইলে এই বিস্তর আলাপ করা যাবে। আমার এই লেখায় মূলত তাঁকে নিয়ে দুটি আলাপের উত্থাপন করতে চাচ্ছি।
শেখ মুজিবুর রহমানকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দেওয়া হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐদিন শেখ মুজিবের সম্মানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) এক সভার আয়োজন করে। লাখো জনতার অংশগ্রহণে আয়োজিত এই সম্মেলনে তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি ঘোষণা করেন।
তৎকালীন সময়ে শেখ মুজিব তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ অবশ্যই একটা উপাধির যোগ্য হয়ে উঠেছিলেন। এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে তোফায়েল আহমেদরা এই উপাধি কোথায় থেকে ঋণ করেছিলেন? যতটুকু ধারণা করা যায় এটা ঋণ করা হয়েছিল চিত্ররঞ্জন দাশের 'দেশবন্ধু' উপাধি থেকে। আহমদ ছফাও এমন একটা অভিযোগ করেছিলেন, যদি আমার স্মৃতি ভুল না করে। অথচ তাঁকে মৌলিক কোনো উপাধি দেওয়া যেতো। সেটা আমরা পারিনি। এটাকেও একটা ব্যর্থতা বলতে পারেন।
তারপর, শেখ মুজিবের জাতির পিতা প্রসঙ্গে যে বিষয়টি পরিস্কার করা উচিৎ? তিনি জাতির পিতা হবেন না কে জাতির পিতা হবেন সেই প্রসঙ্গ আপাতত এখানে আনছি না। তবে একাত্তরের পাটাতনে দাড়িয়ে শেখ মুজিবের ভূমিকাই মূখ্য, এবং তার সমান তখন কেউ হয়ে উঠতে পারেননি। এটাও সত্য যে, তারচেয়ে বড় মাপের নেতারা ছিলেন তখন। কিন্তু তার সমান সাহস, ভূমিকা তখন দেখাতে পারেননি অনেকেই। তবে এটাও সত্য তাঁর অনেক ভূমিকা নিয়েও তর্কবিতর্ক ও প্রশ্নবিদ্ধ রয়েছে। সেদিকে আপাতত না যাই।
শেষ মুজিবকে জাতির পিতা বলতে গেলে আগে ঠিক করতে হবে তিনি কোন জাতির পিতা? বাঙালি না বাংলাদেশের? বাঙালি জাতির পিতা বলতে গেলে দুইটা সমস্যা সামনে এসে দাড়ায়। একটা হচ্ছে তিনি যদি বাঙালি জাতির পিতা হন, তখন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা রাগ করতে পারেন। কারণ, বাঙালি বলতে শুধু বাংলাদেশের বাঙালি বুঝায় না। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গের ও বিশ্বের সকল বাংলা ভাষাভাসি জনগুষ্টি মিলেই বাঙালি। শেখ মুজিব কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালি ছাড়া আর কারো পিতা হতে যাবেন না। দ্বিতীয় যে সমস্যা সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশে শুধু বাঙালিরাই বসবাস করছে না। এখানে বাঙালি ছাড়াও আদিবাসী সহ আরও কয়েকটি জাতির বসবাস এখানে। শেখ মুজিবকে বাঙালি জাতির পিতা বলে তাদেরকে বাদ দিবেন কিভাবে? তারা বাঙালি না হলেও, তারা কিন্তু বাংলাদেশী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্মাণে যে জাতীয়তাবাদের রূপ নিয়েছে, বাংলাদেশী জাতীয়তা বাদ। যেখানে বহু জাতির সমন্বয়ে এই জাতীয়তাবাদ। শেখ মুজিব বাঙালি হলেও তার জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বাংলাদেশী। সুতরাং শেখ মুজিব হতে পারেন বাংলাদেশী জাতির পিতা।
এখন কথা হচ্ছে শেখ মুজিবকে জাতির পিতা মানতে না পারা একটা অংশ বলে যে, জাতির পিতা নাকি ইব্রাহিম (আ.)। উনি একক ধর্মীয় গুষ্ঠির পিতা, বাংলাদেশ তো কোনো একক ধর্মীয় গুষ্ঠির একার নয়। এখানে সব ধর্মের লোকেরাই আছে। একক ধর্মীয় গুষ্ঠির পিতাকে বাকিরা পিতা মানতে যাবে কেন? ইব্রাহিম (আ.) মুসলমানদের জাতির পিতা। এটাতো সারা বিশ্বের মুসলমানদের ক্ষেত্রেও তাই হবে। আলাদা করে বাংলাদেশের মুসলমানদের স্বীকৃতি দিতে হবে কেন? এই স্বীকৃতি দিতে চাওয়াটা হচ্ছে একটা গোজামিল। এরা মূলত শেখ মুজিবকে জাতির পিতা মানতে চায় না। আবার পাকিস্তানে যখন জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন তাদের কোনো সমস্যা নেই। জিন্নাহকে আবার এরাই জাতির পিতা স্বীকৃতি দিয়েছে একাত্তরের আগে এদেশেও, এবং এখনো দিতে চাওয়ার চেষ্টায় আছে। তারা জিন্নাহ কে মানতে পারে, কিন্তু শেখ মুজিবকে মানতে পারে না। তাই শেখ মুজিবের বিপরীতে গিয়ে ধর্মীয় গুষ্ঠির সাহায্য নেয়। এটাই তাদের হিপোক্রেসির নমুনা। তারা যদি শেখ মুজিবের বদলে তৎকালীন সময়ের অন্য কোনো নেতাকে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করতো তখন সেটা বরং বিবেচনায় নেওয়া যেতো।
নীরব চাকলাদার

মন্তব্য করুন: