কীর্তিমান পুরুষ সিলেটের সাধু বাবু

আমার অনেকদিনের ইচ্ছা ‘দি সিলেটিজ’ গ্রুপে সিলেটের এক কিংবদন্তী পুরুষ সিলেটের প্রখ্যাত পরিবার ‘লাল ব্রাদার্সে’এর শ্রী বিমেলন্দু দাস ( সাধু বাবু) কে নিয়ে লেখার । আমার সমস্যা , সাধু কাকার সাথে কয়েকবার ছোটবেলা দেখা হলেও তেমন কোন স্মৃতি আমার নেই উনাকে নিয়ে। কেবল মনেপড়ে সিলেটে রাতে আলোকসজ্জা করে মহাধুমধাম করে দানবীর আর পি সাহের ছেলের সাথে উনার মেয়ে শ্রীমতি দিদির বিয়ের কথা । সম্ভবত: সেটাই ছিল রাতে আলোকসজ্জা করে সিলেটে প্রথম কোন বিশাল বিয়ের আয়োজন । রাতের এই আলোকসজ্জা দেখার জন্য সিলেট শহরের অন্যাান্যদের মত আমার বাবাও আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই বাড়ি দেখাতে।
গতবার দেশে গিয়ে সাধু কাকার জীবন আর কর্মের ইতিহাসসহ উনার পারিবারিক ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা খুঁজতে গিয়ে দেখা হয় উনার ছেলে কুমার দাদার সাথে। উনার কাছ থেকে পেলাম সাধু কাকার ৮৬ বছর বয়সে উনার লেখা আত্মকথার কিছু অংশ ।
ওয়ালে টাংগানো বাধাঁই করা ছবি থেকে কয়েকটি ছবি নিয়েছিলাম সাধু কাকা ও উনার সহধর্মিনীর । সেগুলো খুঁজে পাচ্ছি না এখন আর। সেটা বড়ই পরিতাপের বিষয়। এই আত্মকথার উপর নির্ভর করেই বলছি সংক্ষেপে কিছু কথা ।
সাধু বাবুর পিতামহ ছিলেন সিলেটের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নামকরা ব্যক্তিত্ব ,জমিদার ও ব্যবসায়ী শ্রী বঙ্কবিহারী দাস। তিনি যে কেবল ব্যবসায়ী এবং জমিদার ও বৈষয়িক বিষয়ে একজন দক্ষ মানুষ ছিলেন তা কিন্তু নয় । উনার সাংস্কৃতিক জগতেও ছিল সবল পদচারণা । তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত তবলা বাদক । গান-বাজনা ও বাংলা সংস্কৃতিতে এই পরিবারের ঐতিহ্য বংশপরম্পরায়, আর উনারা , মানে এই পরিবারের লোকজন সেই ঐতিহ্যকে টেনে নিয়ে এসেছেন আজকের দিন পর্যন্ত ।
শ্রী বঙ্কবিহারী দাসের পুত্র শ্রী বিরেন্দ্র লাল দাস ছিলেন সাধু বাবুর পিতা । উনি ছিলেন একাধারে আসামের এমএলএ , সিলেট এইডেড হাই স্কুল , মডেল হাই স্কুলের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি , লোকাল বোর্ডের সভাপতি , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, সিলেট পলিট্যাকনিকেল স্কুল এবং কলেজের পরিচালনা পরিষদের সদস্য ।
ব্রিটিশ রাজের অধীনে চাকুরীতে ছিলেন সম্মানীত প্রথম শ্রেণীর হাকিম(অবৈতনিক ) হিসাবে কর্তব্যরত । সাধু বাবুর শিক্ষা জীবন শুরু হয় লামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, যাহা পাদ্রি স্কুল বলে পরিচিত ছিল । সেখান থেকে বন্দরবাজার দুর্গাকুমার পাঠশালা তারপর রাজা গিরিশচন্দ্র হাই স্কুল এবং পরবর্তীতে এইডেড হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশ করেন । খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী সাধুবাবু স্কুল জীবনে এইডেড হাই স্কুলের ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন । কলেজ জীবন শুরু করেন সিলেটের মদন মোহন কলেজে এবং সেখানকার ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনে বিপুল ভোটে কলেজের ক্রীড়া সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন ।
পরবর্তীতে সিলেট ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন । এই পদে যুগপত ভাবে সম্পাদক ছিলেন উনার আজীবনের অকৃত্রিম বন্ধু ও তৎকালীন সিলেট এমসি কলেজের ক্রীড়া সম্পাদক জনাব কামরুজ্জামান ( কমরু মিয়া ) সাহেব ।
উনাদের সময়ে এবং উনাদের অক্লান্ত প্রচেষ্ঠায়ই অনেক বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে সিলেট ষ্টেডিয়াম তৈরী সম্ভব হয় ।
উনিই সিলেটে প্রথম কলকাতা মোহামর্ডান, মোহনবাগান , ইস্টবেঙ্গল টিমের মত বিখ্যাত টিএমগুলোকে সিলেটে খেলতে নিয়ে আসেন ।
দেশ ভাগের পরও উনার নেতৃত্বেই সিলেটের ফুটবল টিম খেলতে যায় আসামের করিমগঞ্জ , শিলচার , আগরতলায় ।
সমাজসেবায় এই অসাধারণ , আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব সাধু বাবু ছিলেন অতুলনীয় ।
সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে উনি যে কেবল নিজের সম্পত্তি থেকে সিলেট কুদরত উল্লা জামে মসজিদ, বন্দরবাজার জামে মসজিদ , লাল দীঘিরপার মসজিদের জন্যই জায়গা দান করেন তা নয় , যুগল টিলা আখড়ার সভাপতি থাকাকালীন সময়ে আখড়ার অবশিষ্ট জায়গা মসজিদ তৈরীর জন্য দান করে কাজল শাহ মসজিদ নির্মানের ব্যবস্থা করেন ।
মসজিদ , মন্দির , আখড়া সহ হিন্দু -মুসলমানের অগণিত ধর্মস্থানের জন্য টাকা পয়সা ও জায়গা জমি দান করে গেছেন সাধু বাবু এবং উনার পরিবার । এসব ধর্ম স্থানের পরিচালনা পরিষদেরও বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন সারা জীবন ।
সভাপতি ও সম্পাদকের দায়িত্বে যেসকল হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন সে গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ; গোপাল টিলা , কালীঘাট , কালি বাড়ি ,ভোলা ভুলাগিরী আশ্রম ,ভাঙ্গাটিকর আখড়া ,গোবিন্দ জিউ আখড়া , মঙ্গলচন্ডী, মাছুর দীঘিরপার , গোপীনাথ বিশ্বম্ভর, মহাপ্রভু মন্দির বন্দর বাজার । ব্রম্ম মন্দিরসহ অনেকগুলো হিন্দু উপাসনালয়ের জায়গা যেমন সাধু বাবু ও লাল ব্রাদার্সের দান করা জায়গায় সম্পুর্ণ বা আংশিকভাবে উনাদের অর্থে তৈরী তেমনই দুর্গাকুমার পাঠশালা , হাসান মার্কেট, রাজা জিসি হাই স্কুলের জায়গা ও এই পরিবারের দান করা জায়গায় তৈরী ।
আজীবন সাধু বাবু মির্জাজাঙ্গাল প্রাথমিক বিদ্যালয় , মইনুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, রাজা জিসি স্কুলের পরিচালনা পরিষদের বিভিন্ন পদে থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে গেছেন । এ ছাড়া ও সাধু বাবু ছিলেন স্টেশন ক্লাবের সম্পাদক ,সাধারণ সম্পাদক ষ্টুডেন্ট রিলিফ কমিটি , মেম্বার ইষ্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন , পাকিস্তান বয়েজ স্কাউট রেলীর অর্থ সম্পাদক , সিলেট এক্জিবিশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক , মদনমোহন কলেজের গভর্নিং কমিটির সদস্য, লামাবাজার ইউনিয়ন কমিটির দীর্ঘকালীন চেয়ারম্যান , সিলেট পৌরসভার মেম্বার , ভাইস চেয়ারম্যান , ভাইস চেয়ারম্যান কো-অপারেটিভ ল্যান্ড মর্টগেজ ব্যাংক সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে।
সিলেটে ১৯৪৪, ৪৫, ৪৬ সালে সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন করেন সাধু বাবু ও লাল ব্রাদার্সের পরিবার উপমহাদেশের সকল নামী দামী শিল্পীদের নিয়ে । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৪৪ এবং ৪৫ এর সম্মেলন । এই দুই সম্মেলনের মাধ্যমে অর্জিত টাকা দিয়ে সুর সাগর প্রাণেশ দাসের স্কুলের তহবিল তৈরী হয় । যার সম্পাদক ছিলেন ডাঃ বকুল মজুমদার । বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় লাল ব্রাদার্সের ভাইয়েরা ও সাধু বাবু সঙ্গীত অনুষ্ঠান করে অর্থ জোগাড় করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সবসময়ই ।
হযরত শাহ জালালের নিষ্কর জায়গা কসবা নিষ্কর রাখার আন্দোলনে সিলেটের মদরিচ চৌধুরীর পর উনি কনভেনার হিসাবে কাজ শুরু করেন পাকিস্তানের প্রথম দিকে । কসবা নিষ্কর করার এই কাজে উনি একত্রে এবং সাহায্য সহযোগিতায় কাজ করেন সিলেটের সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব , মত-পথ, রাজনীতির ভিন্নতা ও ধর্মের ভিন্নতার ব্যক্তিবর্গের সাথে , উনাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জনাব আজমল আলী চৌধুরী ,জনাব তৈমুর রাজা, সাইফুল আলম খান , হাজি বারী মিয়া , হারুন হোসেন আলী চৌধুরী , হাজী তাহির আলী , নির্মল চৌধুরী , রণেন্দ্র কৃষ্ণ মজুমদার ( ডাঃ বকুল মজুমদার নামে পরিচিত ) হিমাংশু শেখর ধর , মোহাম্মদ ইউছুফ ( তারু মিয়া ) , আমিনূর রশীদ চৌধুরী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী , মামুনুর রশীদ চৌধুরী , জনাব এ জেড আব্দুল্লাহ প্রমুখ ।
দীর্ঘ আন্দোলনের পর পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সকল সরকারের উচ্চতম পর্য়ায়ে দেন-দরবার করে শেষপর্যন্ত সাধু বাবু হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবকে বুঝাতে সক্ষম হন যে ,এরশাদ সাহেবকে যে কোন সহযোগীতার পূর্বশর্ত হিসাবে কসবা নিষ্করের দাবি মেনে নিতে হবে ।
অবশেষে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের সহযোগীতায় সাধু বাবু প্রেসিডেন্ট এরশাদের দ্বারা হযরত শাহজালালের কসবা নিষ্কর ও সকল খাজনা মওকুফ করাতে সক্ষম হন । পরবর্তীতে বেগম জিয়া ভুমি উন্নয়ন কর বসান । সাধু বাবু ও উনার নিষ্কর কমিটি সেই করের বিরুদ্ধে জজ কোর্টে মামলা করেন । নিষ্কর কমিটি এখনো সেই মামলা পরিচালনা করে যাচ্ছেন ।
সাধু বাবু এবং উনার পরিবার লাল ব্রাদার্স একসময় প্রায় সম্পূর্ণ বন্দর বাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মালিক ছিলেন । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ; লাল দীঘি , লাল বাজার , ব্রম্মময়ী বাজার , কাজীর বাজার যার নাম ছিল বাবুর বাজার, হাসান মার্কেট , লালকুটি , রং মহল সিনেমা হল সহ বিশাল এলাকা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ।
এ ছাড়াও ছিল বৃহত্তর সিলেট সহ বর্তমান ভারতের বিভিন্ন এলাকায় লাল ব্রাদার্সের ব্যবসা ও সম্পত্তি । মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ , পন্ডিত জহর লাল নেহেরু , নেতাজি সুভাষ বসু সহ অনেক গণ্যমান্য ভারতীয় রাজনীতিবিদদের সাথে ছিল সাধু বাবুর ব্যক্তিগত পরিচয় ও জানাশুনা । এদের অনেকেই লাল ব্রাদার্সের শেখঘাটস্থ লাল বাড়িতে আতিতেয়তা পেয়েছেন ।
সাধু বাবু ১৯৪৮ সালে ভারতের করিমগঞ্জে বিয়ে করেন রায় বাহাদুর রমণী মোহন দাস ও রায় বাহাদুর নবকুমার দাসের নাতনি ।
উনার দুই মেয়ে ও এক ছেলে । মেয়েদের বিয়ে হয় আরপি সাহের ছেলে ও মির্জাপুরের স্বনামধন্য ডাঃ দুলালচন্দ্র পোদ্দারের সঙ্গে । ছেলে কুমার দা ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে আছেন । সাধু বাবুর জীবন ও পরিবার এবং সিলেটে শহরের এক সময়কার ইতিহাসের নানান দিক নিয়ে একটি বই লিখলেও অনেককিছু অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে ।
নীরব চাকলাদার

মন্তব্য করুন: