সুরমার কাজল জলে…
Post Top Ad

সুরমার কাজল জলে…

২৩/০৬/২০২৫ ০৩:৫০:০২

প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না: ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

সুরমার কাজল বুকের পলিতে গলিত হেম কবি দিলওয়ারের পাওয়া হয়েছে কি না জানিনা তবে তারুণ্যে ঘন্টাচুক্তি নৌকা নিয়ে প্রেমিকার সাথে সুরমার কাজল বুকে হেম নয় প্রেম করতে ঘুরে বেড়িয়েছি। কখনো শারদে কাশবনের সন্ধান করেছি, কখনো পৌষের রোদ মাখা দুপুর মাখামাখি করে কাটিয়ে দিয়েছি। সুরমা নদীতে নৌকার সংখ্যা কম। খেয়াঘাটের নৌকা ছাড়া মাছ ধরার নৌকা চোখেই পড়ে না।


জীবনে প্রথম দেখা নদী সুরমা। সিলেট শহর থেকে গ্রামের বাড়ি গোলাপগঞ্জের লক্ষ্মীপাশা, নানার বাড়ি বালাগঞ্জের নীজ করনসি গ্রামে যেতে হলে ক্বীন ব্রিজ পাড়ি দিয়ে যেতে হতো। সেই ক্বীন ব্রীজ পাড়ি দেয়ার সময়ই প্রথম নদী দেখা। ক্বীন ব্রিজ পাড়ি দেয়ার সময় রিকশাতে কারো না কারো কোলে বসা থাকতাম। কোলে বসেই শৈশবে প্রথম সুরমা দেখি। অবশ্য সুরমা দেখার পূর্বে সুরমা নদী নিয়ে গল্প শোনা হয়। সুরমা নদী নিয়ে শোনা হয় অনেক গান। 


পরিবারে ভাববাদী ইসলামের চর্চা ছিল। তাই শৈশবেই শোনা হয়- সুফী সাধক হযরত শাহজালাল (রহ) ও ৩৬০ আউলিয়ারর সিলেট বিজয় গল্প। সেখানে ইতিহাসের উপাদান ছিল, আবার ছিল লোকগাঁথার গল্প। সুরমা দেখার পূর্বে শুনেছিলাম হযরত শাহজালাল (রহ) জায়নামাজ বিছিয়ে ৩৬০ আউলিয়াকে নিয়ে সুরমা নদী পড়ি দিয়েছেন। সাত শত বছর পূর্বে প্রাচীন শ্রীহট্র রাজ্যের রাজধানীতে প্রবেশের বাঁধা ছিল সুরমা নদী। 


দরবেশ শাহজালাল জায়নামাজ বিছিয়ে সঙ্গী সাথিদের নিয়ে যে স্থান দিয়ে বর্তমান সিলেট নগরে প্রবেশ করেন, সে স্থানের বর্তমান নাম শেখঘাট। অর্থাৎ শায়েখের ঘাট। এইঘাটে হযরত শাহজালাল (রহ)-এর সিলেট বিজয়ের ৭০০ বছর পূর্তিকে স্মরণ করে একটি তোড়ন নির্মান করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। যা সুরমা নদীতীরের একটি ল্যান্ডমার্ক। শৈশবে এ ঘাটেই প্রথম নৌকা চড়া হয়। এখানে খেয়াঘাট আছে। এপাড়ে শেখঘাট, ওপাড়ে বরইকান্দি গ্রাম।


গানে সুরমার কথা প্রথম শুনি "এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা-সুরমা নদী তটে..."। আঞ্চলিক গানে শোনা হয় "সুরমা নদীর তীরে, আমার ঠিকানারে, বাবা শাহজালাল-এর দেশ ছিলট ভূমিরে"। গণসঙ্গীতের প্রবাদ পুরুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কন্ঠে শোনা হয়, হবিগঞ্জের জালালী কইতর, সুনামগঞ্জের কুড়া/ সুরমা নদীর গাংচিল আমি শূন্যে দিলাম উড়া/ শূন্যে দিলাম উড়া রে ভাই যাইতে চান্দের চর/ ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর,/তোমরা আমায় চিনোনি তোমরা আমায় চিনোনি।/


সুরমা নদী নিয়ে গণমানুষের কবি দিলওয়ারের বিখ্যাত কবিতা "ক্বীন ব্রীজে সূর্যোদয়"। সেই কবিতা পাঠ করে যে কেউ ক্বীন-ব্রীজ থেকে সূর্যোদয় দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারে।


ক্বীন-ব্রিজে সূর্যোদয়' কবিতায় কবি লিখেন, "এখন প্রশান্ত ভোর ঝিরঝিরে শীতল বাতাস/ রাত্রির ঘুমের ক্লান্তি মন থেকে ঝেড়ে মুছে নিয়ে/ আমাকে সজীব করে। উর্ধ্বে ব্যাপ্ত সুনীল আকাশ/ পাঠায় দূরের ডাক নীড়াশ্রয়ী পাখিকে দুলিয়ে/ নিচে জল কলকল বেগবতী নদী সুরমার।/ কান পেতে শুনি সেই অপরুপ তটিণীর ভাষা/ গতিবন্ত প্রাণ যার জীবনের সেই শ্রেয় আশা/ সৃষ্টির পলিতে সেই বীজ বোনে অক্ষয় প্রজ্ঞার।/ সহসা ফিরিয়ে চোখ দিয়ে দেখি দূর পূবাকাশে/ তরুণ রক্তের মত জাগে লাল সাহসী অরুণ/ পাখির কাকলি জাগে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে/ দ্বীনের যাত্রার শুরু। অন্তরালে রজনী কূরণ!/ ধারালো বর্ষার মতো স্বর্ণময় সূর্য রশ্মি ফলা/  ক্বীন-ব্রিজে আঘাত হানে শুরু হয় জনতার চলা।/"


কবি দিলওয়ার রক্তে আমার অনাদি অস্থি' কবিতায় লিখেন- পদ্মা তোমার যৌবন চাই/ যমুনা তোমার প্রেম/ সুরমা তোমার কাজল বুকের/ পলিতে গলিত হেম।/


সুরমার কাজল বুকের পলিতে গলিত হেম কবি দিলওয়ারের পাওয়া হয়েছে কি না জানিনা তবে তারুণ্যে ঘন্টাচুক্তি নৌকা নিয়ে প্রেমিকার সাথে সুরমার কাজল বুকে হেম নয় প্রেম করতে ঘুরে বেড়িয়েছি। কখনো শারদে কাশবনের সন্ধান করেছি, কখনো পৌষের রোদ মাখা দুপুর মাখামাখি করে কাটিয়ে দিয়েছি। সুরমা নদীতে নৌকার সংখ্যা কম। খেয়াঘাটের নৌকা ছাড়া মাছ ধরার নৌকা চোখেই পড়ে না।


এক পূর্ণিমার রাতে সুরমার জলে স্রেফ চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখবো বলে নৌকা ভাড়া করেছি। উথালপাতাল জ্যোছনায় মাঝি সুর তুলেছে 'তুমি আসমানেরও চাঁদ/ আমি সুরমা নদীর নাইয়া/ একবার যদি দিতায় দেখা। চাননি ঘাটো আইয়া/'। 


এসব নব্বই দশকের গল্প। সুরমা দিয়ে গত দুই দশকে বহু জল প্রবাহিত হয়েছে। জীবনের চাওয়া ও পাওয়ার গল্পে বহু অনুগল্প যুক্ত হয়েছে। সেই মাঝিকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজেই হয়ে গেছি 'সুরমা নদীর নাইয়া'। শুধু চান্নি ঘাটে সেই প্রেমিকাকে আসতে বলা হয়নি। তাই সে আসেনি। অভিমান করে জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু সুরমা নদী আমার জীবনে রয়ে গেছে। আমার জীবন ও কর্মের সাথে সুরমা নদী জড়িয়ে যায়। সুরমার ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলি। অংশীজনেরা গুরুত্বের সাথেই আমার কথা শুনতে চান। গত দুই দশকে সুরমা নদী নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় অসংখ্য গণমাধ্যমে সুরমা নদীর ভ্যানগার্ড হয়ে কথা বলেছি। 


২০০৬ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা)-এর সাথে যুক্ত হই। সিলেটে গঠন করা হয় 'সিলেট পরিবেশ আন্দোলন (সিপা)। সিপা-র পক্ষ থেকে প্রথম কর্মসূচি পালন করি সুরমা নদী নিয়ে। সুরমার উজানে ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ক্বীন-ব্রীজের নিচে আয়োজন করা হয় প্রতিবাদ কর্মসুচীর। পরবর্তীতে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে অসংখ্য কর্মসুচী পালন করা হয়। সুরমার দখল-দূষণ নিয়ে সামাজিক আন্দোলন শুরু করি। বিভিন্ন এলাকায় অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধে নাগরিকদের সংঘবদ্ধ করে বহু কর্মসুচী পালন করি। সুরমার সাথে যুক্ত ছোট নদী, শাখা নদী, উপনদী রক্ষায় সরব হই। এভাবে চলে যায় আট বছর। 


২০১৪ সালে নদী ও পানি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন 'ওয়াটারকিপার এলায়েন্স' আমাকে সুরমা নদীর মুখপাত্র হিসাবে Surma River Waterkeeper হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০১৪ থেকে ২০২৫ সাল। আরো এগারো বছর চলে গেছে। আঠারো বছরে সুরমা নদীর পানি সুপেয় হয়নি। বাংলাদেশের কোন নদী পূর্বের অবস্থায় আর ফিরে যায়নি। তাই সুরমার দূষণও বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তবে সুরমা নদী নিয়ে একের পর এক অসংখ্য কর্মসুচী পালন ও সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখা গেছে বলে সুরমা নদী দেশের অন্যান্য নদীর মত দূষণ ও দখল লাগামহীন হয়নি। বরং নগরীর বাণিজ়্যিক এলাকার দখল উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়েছে। সুরমাতে ছড়া দিয়ে আসা আবর্জনার অনেকটুকু সিটি কর্পোরেশন পরিচ্ছন্ন করছে। এই চাপটুকু অব্যাহত রাখতে হবে।


লেখক

সংগঠক, ওয়াটারকিপার ও সাধারণ সম্পাদক, বাপা সিলেট

মীর্জা ইকবাল

মন্তব্য করুন:

Post Bottom Ad
Sidebar Top Ad
Sidebar Botttom Ad