নেতানিয়াহুর ওপর সব দিক থেকে চাপ বাড়ছে?
Post Top Ad

নেতানিয়াহুর ওপর সব দিক থেকে চাপ বাড়ছে?

২৮/০৫/২০২৫ ০৯:৫৫:৫২

প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না: ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের কাছেই সমালোচিত হচ্ছেন। ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন অব্যাহত থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিবৃতিগুলোতে সুর পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, ভবিষ্যতের কূটনৈতিক দৃশ্যপট আরো জটিল হওয়ারও ইঙ্গিত মিলছে। গাজায় ১৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধের পর নেতানিয়াহুর বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ধৈর্যের বাঁধে ভাঙন তৈরি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো ঘনিষ্ঠ মিত্রদের বক্তব্যেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।

জার্মানিতে অস্থিরতা
গাজায় ইসরায়েলের কৌশল নিয়ে বিরল এক সমালোচনা এসেছে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মেৎসের কাছ থেকে। বার্লিনে রিপাবলিক সম্মেলনে সোমবার তিনি বলেন, হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের লড়াইয়ের অংশ হিসেবে বেসামরিক নাগরিকদের দুর্ভোগকে ‘আর ন্যায্যতা দেওয়া যায় না’।

ইসরায়েলের প্রতি জার্মানির বিশেষ দায়িত্বের ওপর জোর দিলেও তিনি বলেন, ‘কিন্তু যখন সীমা অতিক্রম করা হয় এবং মানবিক আন্তর্জাতিক আইন স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করা হয়, তখন জার্মানি ও জার্মান চ্যান্সেলরকে অবশ্যই কথা বলতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ইসরায়েলের এমন আচরণ করা উচিত নয়, যা তার নিকটতম মিত্রদেরও বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে।

জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইওহান ভাডেফুল সোমবার গাজার মানবিক পরিস্থিতিকে ‘অসহনীয়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। মানবিক মর্যাদা ও আন্তর্জাতিক আইনের মূল্যবোধ এবং ইসরায়েলের প্রতি জার্মানির প্রতিশ্রুতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জও তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন।

২০২৩ সালে জার্মানি ইসরায়েলে প্রায় ৩৩ কোটি ইউরো মূল্যের অস্ত্র রপ্তানি অনুমোদন করেছে। এর মধ্যে সামরিক সরঞ্জাম ও যুদ্ধের অস্ত্রও রয়েছে, যা ২০২২ সালের তুলনায় ১০ গুণ বেশি।
২০২৪ সালে এটি ছিল ১৬ কোটি ইউরো।

চাপ বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রও
ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনাও ক্রমে বাড়ছে। আগের পূর্ণ সমর্থনের অবস্থান থেকে সরে এসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউ জার্সিতে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ইসরায়েল, আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলছি, এবং আমরা দেখতে চাই, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুরো পরিস্থিতি বন্ধ করতে পারি কিনা।’

এসব মন্তব্য মূলত প্রতীকী হলেও পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ইউসিলুভাইনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এলেনা আউন ডিডব্লিউকে বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতানিয়াহুর ওপর ততটা খুশি নন, যতটা তিনি তার ম্যান্ডেটের শুরুতে ছিলেন।
অবশ্যই আরো উত্তেজনা রয়েছে।’

আউন অবশ্য মনে করেন, কথাবার্তায় পরিবর্তন সত্ত্বেও ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সামরিক ও আর্থিক সহায়তা নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রয়েছে।

সতর্ক অবস্থানে দ্বিধাবিভক্ত ইইউ
ইউরোপীয় ইউনিয়নও ইসরায়েলের সঙ্গে তার সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করার কথা জানিয়েছে। গত সপ্তাহে জোটের বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইইউ-ইসরায়েল অ্যাসোসিয়েশন চুক্তির পর্যালোচনা করার কথা জানিয়েছেন। এই অ্যাসোসিয়েশন ইইউ ও ইসরায়েলের মধ্যে বাণিজ্য ও রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে। ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কায়া কালাস গাজায় মানবিক সাহায্যের বর্তমান স্তরকে ‘সমুদ্রের এক ফোঁটা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

আউন অবশ্য মনে করেন, ‘এটি কথার পরিবর্তন, পদক্ষেপের নয়। বাণিজ্যচুক্তি পর্যালোচনা করা কেবল শুরু। ইইউকে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ইসরায়েল অনুচ্ছেদ ২ লঙ্ঘন করছে কিনা।’ এই অনুচ্ছেদে ইইউ ও ইসরায়েলের মধ্যে বাণিজ্যকে মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সংযুক্ত করে।

ইইউর ২৭ সদস্যের মধ্যে মোট ১৭টি দেশ এই পর্যালোচনাকে সমর্থন করেছে। জার্মানি, হাঙ্গেরি ও চেক প্রজাতন্ত্র এই পদক্ষেপের বিরোধিতাকারীদের মধ্যে ছিল। ইসরায়েল তাদের প্রকাশ্যেই ধন্যবাদ জানিয়েছে।

ডিডব্লিউর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্যারিসের ইফ্রি নিরাপত্তা কেন্দ্রের গবেষক আমেলি ফেরি জোর দিয়ে বলেছেন, সংঘাতের ওপর ইউরোপের প্রভাব এখনো সীমিত রয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রই প্রধান অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহকারী, তাই তাদের সমর্থন, অথবা এর অভাব, সবচেয়ে বড় পার্থক্য তৈরি করবে।’

আইসিসির পরোয়ানা
আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের সমালোচনার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গত বছরের নভেম্বরে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। প্রতীকীভাবে এই পদক্ষেপটি তাৎপর্যপূর্ণ হলেও বাস্তব পরিবর্তনের দিক থেকে এটি এখনো সীমিত বলে মনে করেন আউন। তিনি বলেন, ‘জার্মানি, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম—সবাই ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা এই পরোয়ানা কার্যকর করবে না। এটি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা তুলে ধরে।’

ফেরি অবশ্য এই বিষয়ে একমত নন। তিনি বলেন, এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেতানিয়াহু ও তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চলাচলের স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করেছে। ফলে তারা পরোয়ানা কার্যকর হতে পারে—এমন কোনো দেশে ভ্রমণ করলে গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় পান।

এই পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কোনো চলমান সংঘাতের জন্য আইসিসি একটি গণতান্ত্রিক দেশের বর্তমান নেতাকে লক্ষ্যবস্তু করেছেন। নেতানিয়াহু অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন, এই সিদ্ধান্তকে ‘অসম্মানজনক’ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন, ইসরায়েল আত্মরক্ষায় ব্যবস্থা নিচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ চাপ
গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, তারা এখন গাজার প্রায় ৪০ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে এবং আগামী দুই মাসের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ভূখণ্ড দখল করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের মতো সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, ১১ সপ্তাহের অবরোধের পর সীমিত সাহায্যের অনুমতি দেওয়া সত্ত্বেও মানবিক পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, উপত্যকায় প্রায় ৫৪ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত ও প্রায় সোয়া এক লাখ মানুষ আহত হয়েছে।

ইসরায়েল সরকার কেবল গাজা নয়, পশ্চিম তীরে দেশটির নীতির জন্যও সমালোচনার মুখে পড়েছে। অবৈধ বসতি সম্প্রসারণের অভিযোগে অতি ডানপন্থী ইসরায়েলি চরমপন্থীদের সম্প্রতি যুক্তরাজ্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ব্রিটিশ নীতির একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এটি।

ইসরায়েলের ভেতরেও সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের বিরোধিতা বাড়ছে। জিম্মিদের পরিবার ও নাগরিক সমাজের গোষ্ঠীগুলোর বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। তবে গবেষক এলেনা আউন মনে করেন, জনগণের বেশির ভাগই এখনো এই যুদ্ধকে সমর্থন করে। তিনি বলেন, ‘জরিপগুলোতে দেখা যায়, ৫০ ভাগেরও বেশি নাগরিক চলমান অভিযানকে সমর্থন করেন।’

মীর্জা ইকবাল

মন্তব্য করুন:

Post Bottom Ad
Sidebar Top Ad
Sidebar Botttom Ad