আমি যে সিলেটি!

আমরা কোন বেনিয়া না। আমরা জলদস্যু না। তবু যেন কেবল সিলেটি উত্তরাধীকারেই রক্তে আছে দেশ বিদেশে বেড়িয়ে পড়ার অস্বাভাবিক সাহস ও বোকার মত ঝাঁপিয়ে পড়ার রোগ।
এই ধরুন আমিও যে বিলেতে দুটি অপরিণত বয়সের সন্তান নিয়ে শিক্ষকতার চাকুরী করতে চলে এসেছিলাম! কেন? পাগল না! দেশেতো তখন আমার বৃহষ্পতি তুংগে ছিল। আজাদ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী বিটিসি ছেড়ে জিইসিতে ফাইন্যান্স ম্যানেজার। আমি তখন লম্বাচুল পিঠে ফেলে ঢাকাই শাড়ি পড়ে মুখে ওয়েল অব ইউলি মেখে মায়াধারী ড্রাইভার প্রবীন নবী হোসেন কে সাথী করে একবার মতিঝিলে বিচিত্রা, আবার টিভি ধারাবাহিক 'জীবন যেমন'র জন্য রামপুরা, তারপর মিরপুর রোড ঢাকা কলেজে মাস্টারি করে বিকেলে জলের বোতল ও বাচ্চাদের নিয়ে শাহবাগে আর্ট কলেজে দৌড়া দৌড়ি করছি। রাতে বন্ধুদের আড্ডায় আপাদমস্তক পাগলামি কিংবা নাচের ফ্লোরে ফিনফিনে আঁচল দোলাচ্ছি। আমার হাতে হাতে গল্পে ও কবিতায় উঠে আসছে করমচা, দুধ ধান, শহীদ মিনার। - দেশী লাইফ স্টাইল ও ফ্যাশন প্রবর্তন ও জার্নালিজম করছি ধুন্দুমার। সেই মধ্য আশিতে আমার মত মাঠে নামা নারী সাংবাদিক খুব কম ছিল। আমি সে সুযোগে কিংবদন্তী সম্পাদক শাহাদত চৌধু্রীর অসাধারণ ব্রিফিং এ এমন সব কভার স্টোরি করছি যে সব মিলিয়ে দেশে প্রায় হাউসহোল্ড নাম হয়ে উঠেছিলাম।
সেই আমিও এক ফ্রস্টভরা ভোরে লন্ডন হিথ্রোতে এসে নামলাম। আমি যে সিলেটি! এ যে আমাদের সেকেন্ড হোম। সাত সাগর তেরো নদীর পাড়ে হলেও ততদিনে এই হোমে হাতকড়ার সুগন্ধ এসে গেছে। পেপারের মত পাতলা পরতে সমুসা তৈরীর ময়দার ডো’র মত উপকরণ পাওয়া যাচ্ছে। আমীন আলীর জামদানী নামে রেস্টুরেন্ট আছে। যার ডেকোরেশনের জন্য এবং প্রদর্শনীর জন্য আমিই দেশ থেকে মহা সুন্দর সুন্দর জামদানী পাঠিয়েছিলাম। জামদানী সেমিনারে অংশগ্রহন করতে এসে আমার পরিচয় হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও সে সময়ের রাষ্ট্রদূত শফিউল্লাহ স্যারের সঙ্গে। বিলেতের বসবাসরত নামকরা বাংলাদেশী ব্যক্তিত্বদের বন্ধু হয়ে গেছি। তারপর ক্রমে ক্রমে শুনতে পেয়েছি পিটার শ’র পর রাজনউদ্দিন জালালই হবেন বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত প্রথম ব্রিটিশ এমপি! কি আশ্চর্য তিনি হয়ে গেলেন বন্ধু, আর জালালই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ইস্ট এ্যান্ডের বিখ্যাত এ্যাক্টিভিস্ট দম্পতি ডেনিস ও ডান জোন্সের সঙ্গে। বিস্ময়ে দেখি এখানে আছে ‘ব্রিকলেন’ নামে আমার বাপদাদার ভিটে! সব চেয়ে বড় কথা দেশের বাইরে বাংলাদেশের সংস্কৃতি আছে এখানেই।
আর সব চেয়ে স্বস্তির কথা ততদিনে নিজের ভাইবোনরা লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফিরে গেলেও আমার ব্যাচের মানে আমাদের বিস্তারিত পরিবারের ভাইবোন ও জ্ঞাতিরা এদেশে দিব্বি জাকিয়ে বসেছেন সর্বত্র, এদেশে এদের সন্তানদের পা পড়েছে সবস্থানে, কোন ক্ষেত্রই নেই আর বাকি। হালঘরের ফর্সা ফুপাতো ভাই, জামাল ভাই কার্ডিফে, সুদর্শন শাহাবুদ্দিন ভাই বার্মিংহামে, বড় চাচার ঢলঢলে চোখের বড় মেয়ে- বড় বুজান লন্ডন হ্যারোতে, সুন্দর ফুপুর লম্বা লাবন্যময়ী মেয়ে শাহিদা আপাও। ওর ছোট বোন ছটফটে সালেহা সাউদাম্পটনে, ছোট চাচার মেয়ে সাকি সাউথ শিল্ডে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতোকোত্তর করা বড় মামার বড়ছেলে এনাম ভাই, চাটগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতোকোত্তর করা মেঝমামার বড়ছেলে বাবলু ভাই ও মামার বড়মেয়ে দিনাবু তার জিপি ডাক্তার বর, বড়খালার মেয়ে আছিয়া ও তাঁর ব্যবসায়ী বর সহ আরো অনেকে- কেউ পড়তে, কেউ কাজ করতে, কেউ বিয়ে করে এদেশে এসে নানান স্থানে বাস করছেন। এবং আমার সেকেন্ড কাজিনদের কৃতী ছেলেমেয়েরা এত সব করছে যে শুধু তখন গান বাজনা বাকি আছে। আমরা একত্র হলে হল বুক করতে হয়, বাড়ির বাহান দিয়েও কুলায় না।
আমার অসম্ভব রূপবতী সব কাজিনদের সৌন্দর্যের কারনে যখন ফটাফট বিলেতে বিয়ে হতে লাগলো, তখন আমার বোন বুজানের বিয়ে হল বাংলাদেশে বিটিসিতে চাকুরিরত পাত্রের সঙ্গে। কিন্তু তিনিও ৭০ সালে কস্ট এ্যাকাউট্যান্সি পড়তে বিলেতে এসেছিলেন। আর ৭২ এ আমার বিয়ে হোল তাও বিলেত ফেরত চার্টাড এ্যাকাউন্ট্যান্টের সঙ্গে। বলে বুঝাতে পারবো না বিলেত আর সিলেট কিভাবে আঠা হয়ে আছে আমাদের জীবনে। কিন্তু আজাদ সিলেটি না। সে চট্টগ্রামের, সন্দীপের। দ্বীপ থেকে বেরিয়ে এখানে বিলেতে পড়তে আসে এবং সে সন্দীপের প্রথম বিলেত পাশ চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্ট। কিন্তু আমার বিয়ে একজন ননসিলেটির সঙ্গে হল যা এক ব্যতিক্রম। সেই আমার মামা, মায়ামামার পর আমাদের প্রজন্মে এই প্রথম সিলেটের বাইরে বিয়ে।
বর্তমানে আমাদের বৃহত্তর পরিবারে এদেশে লেখক, ফার্মাসিস্ট, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, লেখক, ডাক্তার, উকিল, ব্যাংকার কি নেই এখন! শুধু গায়ক ছিল না। সেটাও হয়েছে বছর সাতেক আগে। বড় বুজান, বেদানা আপার আর্কিট্যাক্ট ছেলে নাম নাসের সুফিয়ান। ডাকনাম সোহেল। ওদের তিন ভাইয়ের দুজনই আর্কিট্যাক্ট ও একজন ইঞ্জিনিয়ের। হঠাৎ একদিন এক পারিবারিক জন্ম উৎসবে ওর ফরেন্সিক অফিসার স্ত্রীসহ এগিয়ে এসে কুশল জিজ্ঞাসা করেই একটা কিছু আরো বলবে বলে মিষ্টি করে হাসছিলো। স্ত্রী ইশারা করতেই সে শর্মিন্দা ভাবে একটি ভিজিটং কার্ড গুজে বলে, খালা আই হ্যাভ গিভেন আপ জব। তো হাসির কি আছেরে বাপ? এতো বেদনার কথা। তাকিয়ে দেখি সে কার্ডে মাইক্রোফোন হাতে এ্যালভিস প্রিসলির সেই বিখ্যাত সাদা চুমকী স্যূট পরে গান গাইছে আমাদের সোহেল। ও মাই গড আমাদের সোহেল এ্যাল্ভিস প্রিসলী ইম্পারসোনিস্ট আর্টিস্ট! সে যে গান করতে পারে তাইতো জানতামই না। একি কান্ড! আমারই রক্ত ও বংশবীজই এখন বিশ্বের এক মাত্র এশিয়ান এলভিস প্রিসলী! ভাবা যায়! ভাবতে অসম্ভব ভালো লাগে উপন্যাসিক জিয়া হায়দার রহমান, ফুটবলার হামজা চৌধুরী আমাদেরই বংশবীজ!
(নোট : লেখাটি সিলটিজ গ্রুপ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)
লেখক :
কবি,ঔপন্যাসিক
লেখকের আত্মজৈবনিক উপন্যাস
'বংশবীজ' থেকে
প্রকাশকঃ সময়
পাবেন রকমারি ডট কম এ
বংশবীজ
পর্ব ১৩
২০১৮
প্রথম ডেস্ক :

মন্তব্য করুন: