রাঘববোয়াল : ভাষার বাগধারায় প্রতাপের প্রতিচ্ছবি
Post Top Ad

রাঘববোয়াল : ভাষার বাগধারায় প্রতাপের প্রতিচ্ছবি

২৬/০৫/২০২৫ ০৮:১৮:৪৮

প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না: ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

বাংলা ভাষায় প্রতিদিনের কথাবার্তায় ব্যবহৃত বাগধারাগুলো কেবল শব্দের খেলা নয়, বরং সেগুলোর পেছনে লুকিয়ে থাকে ইতিহাস, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও নৈতিকতার গভীর ইঙ্গিত। এরকমই একটি বাগধারা হলো “রাঘববোয়াল”—যা দিয়ে বোঝানো হয় প্রভাবশালী, দুর্ধর্ষ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের যাঁরা সাধারণত সমাজে ‘হোমড়াচোমড়া’ নামে পরিচিত। কিন্তু এই বাগধারার উৎপত্তি ও তাৎপর্য যে কত গভীর, তা আমরা বুঝতে পারি ভাষাতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র, মিথ ও সাহিত্যসম্ভারের বিশ্লেষণ থেকে।


রাঘব শব্দের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য


‘রাঘব’ শব্দটি এসেছে ‘রঘু’ শব্দ থেকে, যা এক রাজবংশের নাম। রঘুকুল বা রঘুবংশ হল সেই মহান রাজবংশ, যাঁর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন রাজা রামচন্দ্র। রামের পরিচয়ে তিনি শুধু রাজা নন, বরং আদর্শ পুরুষ, ন্যায় ও নীতির প্রতীক। এই বংশীয় পরিচয় থেকে ‘রাঘব’ শব্দটি একটি রাজকীয় অভিঘাত লাভ করে—যার মধ্য দিয়ে বোঝানো হয় গৌরব, শক্তি এবং কর্তৃত্ব। যেমন সাহিত্যে আমরা পাই—"আমি কি ডরাই, সখি, ভিখারী রাঘবে?" — যেখানে প্রমীলা তার আত্মবিশ্বাস ও বীরত্বের ঘোষণা দেয়। এই বাক্যটি আমাদের দেশে আগে মাধ্যমিক পর্যায়ে বাংলা ব্যাকরণে কারক বিভক্তি নির্ণয়ের প্রশ্নে আসত। প্রমীলার এই উচ্চারণের এক ইতিহাস আছে : লঙ্কায় রাম-বাবণের যুদ্ধে স্বামী মেঘনাদের মৃত্যুতে কাতর প্রমীলা তার সখি বাসন্তীকে বলল, এ ফুলমালা কার চরণে দেব? চল সখি, লঙ্কাপুরে গিয়ে দেখি, এমন কার সাহস, দানবরাজের প্রাণ হরণ করে? উত্তরে সখি যখন বলল, কীভাবে লঙ্কাপুরে যাবে? চারিদিকে লাখ লাখ শত্রু লঙ্কা ঘিরে রেখেছে। শুনে বজ্রের মতো গর্জে উঠে প্রমীলা বলল, কী বললে সখি? দানব নন্দিনী আমি, রক্ষ-কুল-বধূ;/রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,/আমি কি ডরাই, সখি, ভিখারী রাঘবে? বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর বিখ্যাত ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের তৃতীয় সর্গে এভাবে বাংলা সাহিত্যের আধুনিকা রমণী, তেজস্বিনী, স্বাধিকারচেতনা ও ব্যক্তিত্বশীলা নারী হিসেবে মেঘনাদের স্ত্রী প্রমিলাকে উপস্থাপন করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত রাঘবই রাক্ষসকুলকে ধ্বংস করে লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধার করেছে।


মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে রাঘব নামের ব্যবহার কেবল পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাব্যিক উচ্চারণ নয়, বরং তা সাহিত্যের এক শক্তিশালী চরিত্র চিত্রণের মাধ্যম। রাঘব এখানে একাধারে প্রতাপশালী ও বিজয়ী, আবার প্রমীলার চোখে সে এক ‘ভিখারী’—এতে আছে নারীর দ্রোহ ও বীর্য গাথা।


বোয়াল মাছ: প্রকৃতি থেকে রাক্ষুসিতা


‘বোয়াল’ একটি বড়ো আকারের রাক্ষুসে মাছ, যা মিঠা পানিতে পাওয়া যায়। এই মাছ অন্যান্য ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে, এবং তাই এটি প্রকৃতিতে এক ধরণের প্রভাবশালী ও ভয়ংকর অস্তিত্বের প্রতীক। আবার সমুদ্রের গভীরে পাওয়া যায় আরও বড় এক প্রজাতির প্রাণী—রাঘব, যা এতটাই বিশাল যে সে তিমিঙ্গিলকে যে গিলে ফেলতে পারে তাকেও গ্রাস করতে সক্ষম।

নীতিশাস্ত্রে উল্লেখ আছে—

“অস্তি মৎস্যস্তির্মিনাম শতযোজন বিস্তৃতঃ।

তিমিঙ্গিলগিলোহপস্তি তদগিলোহপস্তি রাঘবঃ॥”

অর্থাৎ, বিশাল আকৃতির মাছ তিমিঙ্গিলকে গিলে ফেরতে পারে যে প্রাণী (তিমিঙ্গিলগিলোহপস্তি) তাকে পর্যন্ত গিলে ফেলতে পারে যে প্রাণী, সে-ই ‘রাঘব’ (তদগিলোহপস্তি রাঘবঃ), সমুদ্রের প্রাণী (এখনো এই প্রাণীর সন্ধান যদিও মেলেনি)। এই দৃষ্টিতে ‘রাঘববোয়াল’ মানে এমন এক ভয়ংকর শক্তি, যা অন্য সব প্রাণী বা শক্তিকে সহজেই গ্রাস করতে পারে। শতযোজনের বিস্তৃতি প্রায় পনেরো শত কিলোমিটার। এমনিতে নীল তিমি ৩০ মিটার বা একশ ফুট লম্বা হয়, ওজন ১৮০ থেকে ২০০ টন।  “শতযোজন বিস্তৃতঃ” কথাটি ‘বিশালতা’ বোঝাতে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে যেমনটি এক বিশ্বনেতা সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তানের সমস্যাকে দেড় হাজার বছরের বিরোধ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখানেও ‘বহুদিনের’ বা ‘দীর্ঘ সময়ের’ রূপক অর্থে ব্যবহৃত ব্যবহৃত হয়েছে ‘দেড় হাজার বছর’। আমরাও দৈনন্দিন জীবনে ‘একাধিকবার’ কথাটা বোঝাতে দশ বার, চোদ্দ বার, বিশ বার, পঞ্চাশ বার, একশ বার, তিনশষাট বার, এক হাজার বার ইত্যাদি শব্দবন্ধের মাধ্যমে প্রকাশ করি। প্রকৃত যোজন সম্বন্ধে একটু বলা যেতে পারে : যোজন প্রাচীন ভারতের দূরত্বের একক। রামায়ণ অনুসারে পুষ্পক রথে চড়ে রাবণ ও লাফ দিয়ে হনুমান শত যোজন বিস্তৃত সাগর পার হয়ে লঙ্কায় পৌঁছেছিল। “গুপী গাইন বাঘা বাইন” চলচ্চিত্রে ষুণ্ডি থেকে হল্লা রাজ্যের দূরত্ব ছিলো ২০ যোজন।


বিষ্ণুপুরাণ এর ষষ্ঠ খণ্ডের প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে-

১০ পরমাণু= ১ পরাসুক্ষ্ম; ১০ পরাসুক্ষ্ম= ১ ত্রসরেনু; ১০ ত্রসরেনু= ১ মহীরজ; ১০ মহীরজ= ১ বালাগ্র; ১০ বালাগ্র= ১ লিক্ষা; ১০ লিক্ষা = ১ যুক; ১০ যুক= ১ যবোদর; ১০ যবোদর= ১ যব; ১০ যব = ১ অঙ্গুলি(প্রায় ৩/৪ ইঞ্চি); ৬ অঙ্গুলি= ১ পদ; ২ পদ = ১ বিতস্তি; ২ বিতস্তি = ১ হস্ত; ৪ হস্ত = ১ ধনু; (১ দন্দ অথবা পৌরুষ অথবা নারীকা= ৬ ফুট; ১হস্ত=১.৫ফুট); ২০০০ ধনু= ১ গব্যুতি = ১২০০০ ফুট; ৪ গব্যুতি= ১ যোজন= ৯.০৯ মাইল বা ১৪.৬৩ কিলোমিটার। 

বাংলা ভাষায় আমরা দেখি, রাম শব্দটি বৃহৎ বা বিশাল অর্থে ব্যবহৃত হয়—রামদা, রামছাগল ইত্যাদি। একইভাবে, ‘রাঘব’ শব্দটিও বিশালতা ও প্রভাবের প্রতীক হয়ে ওঠে। সমুদ্রের রাঘবের বাইরে বড়ো বোয়ালকেও ‘রাঘববোয়াল’ (বড়ো রাক্ষুস অর্থে)  মনে করা হয়। 


সমাজ ও ব্যঙ্গের ভাষায় রাঘববোয়াল

  • যখন আমরা কাউকে ‘রাঘববোয়াল’ বলি, তখন এর অর্থ হয়ে দাঁড়ায় প্রভাবশালী, দুর্নীতিপরায়ণ, অপ্রতিদ্বন্দ্বী কোনো ব্যক্তি—হোন তিনি রাজনীতিক, আমলা কিংবা ব্যবসায়ী। সমাজে তাঁরা জনস্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করেন, কিন্তু তাঁদের টলানো কঠিন। এই বাগধারার প্রয়োগ একটি ব্যঙ্গাত্মক ভাষা রূপে ব্যবহৃত হয় যাতে এই শ্রেণির মানুষের অপরিমেয় প্রভাব এবং দায়বদ্ধতার অভাব তুলে ধরা হয়।


এর বিপরীতে ‘চুনোপুঁটি’ কথাটি এসেছে ছোট মাছ চুনো ও পুঁটির মিলনে। এই বাগধারায় বোঝানো হয় নগণ্য, দুর্বল, গুরুত্বহীন ব্যক্তি, যাদের কোনো প্রতাপ নেই। সমাজে ‘চুনোপুঁটি’রা ‘রাঘববোয়াল’দের দ্বারা চিরকাল দমিত।

রাঘববোয়ালের নৈতিক পাঠ নৈতিক দর্শনে এবং রূপকের জগতে ‘তিমি’ বা ‘তিমিঙ্গিল’ এক বিশাল শক্তির প্রতীক, যা যদি অনিয়ন্ত্রিত হয় তবে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। ‘রাঘববোয়াল’ তাই কেবলমাত্র বাহ্যিক শক্তির নয়, বরং এক নৈতিক প্রশ্নেরও প্রতীক। বিশাল ক্ষমতার সঙ্গে আসে বিশাল দায়—যা অনেক সময় উপেক্ষিত হয়।


যেমন বাইবেলের ইয়োনাহ কাহিনিতে আমরা দেখি, তিমির পেটে তিন দিন কাটানো আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। তেমনই, আজকের রাঘববোয়ালদেরও সমাজের জন্য কল্যাণকর হতে গেলে প্রয়োজন introspection বা আত্মজিজ্ঞাসার।

উপসংহার: ভাষা ও সমাজের চোখে রাঘববোয়াল।


‘রাঘববোয়াল’ শব্দটি তাই একাধারে প্রকৃতি, রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্যদ ও নৈতিকতা—সবকিছুর সংমিশ্রণে গঠিত এক বাগধারা। এটি কেবল একটি শব্দ নয়, বরং এক সামাজিক ব্যঙ্গ, নৈতিক প্রশ্ন এবং সাহিত্যিক চিত্রণের পরিপূর্ণ প্রতীক।

আজকের প্রেক্ষাপটে যেখানে সমাজে রাঘববোয়ালদের সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে ভাষা আমাদের সচেতন করে দেয়—“চুনোপুঁটিরাও একদিন জোট বাঁধলে রাঘববোয়ালকে ঠেকাতে পারে।” এই সম্ভাবনার পথ রচনাই আমাদের ভাষা ও চিন্তার চূড়ান্ত অর্জন।


শেষ কথা:

ভাষার এমন বাগধারাগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ইতিহাস ও বর্তমানের সেতুবন্ধন। রাঘববোয়াল সে ভাষারই এক জীবন্ত প্রতীক—যেখানে প্রতাপের আড়ালে লুকিয়ে থাকে সমাজের বিবেকের আহ্বান।


লেখক পরিচিতি

মিহিরকান্তি চৌধুরী

লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার সিলেট।


মিহিরকান্তি চৌধুরী

মন্তব্য করুন:

Post Bottom Ad
Sidebar Top Ad
Sidebar Botttom Ad