তবুও, হাসি পুষ্পের হাসি!
Post Top Ad

তবুও, হাসি পুষ্পের হাসি!

নিরঞ্জন দে

০৯/০৮/২০২৫ ২৩:০৪:৫৩

প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না: ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসি অর্থহীন, অসম্ভব। কবি নজরুল যে রূপকে (Metaphorical) কথাটি বলেছিলেন তা অনুধাবন করার ক্ষমতা এ সমাজে ক'জনের আছে? গোবরে পদ্মফুল ফুটলেও তার গায়ে গন্ধটা লেগেই থাকে। ঐ পদ্ম দেবমাল্যে স্থান পায়না। উলুবনে বেজায় মুক্তো ছড়ান, কি লাভ তাতে? অন্ধ পরিবেষ্টিত স্থানে বসে বসে চশমার গান-গল্প শুনান! ফলাফল কি হবে? পাত্র উত্তম নাহলে উত্তম দ্রব্য তার সংস্পর্শে নিজের গুণাগুণ হারায়। চারদিকে ভদ্রবেশী শিক্ষিত প্রতারক, তেলবাজ, স্বার্থান্ধ চতুর মানুষ। আপনি ওদের মাঝখানে পড়ে কি এমন মহৎ কর্মটি করবেন যে এর প্রভাব পড়বে ওদের উপর? হয় নীরবে কষ্ট পাবেন, নাহয় একসময় টিকে থাকার জন্য নিজেও ভিড়বেন ওদের দলে। স্থান কাল পাত্র অনুযায়ী সবকিছুই নির্ধারিত ও মূল্যায়িত হয়।


আপনি মহৎকাব্য রচনা করেন, আর সাহিত্য - সঙ্গীত, থিয়েটার, নানা শিল্পকর্ম - যাই করেন, সঙ্গটা আসল নিয়ামক। সঙ্গ গুণে লোহাও জলে ভাসে। সঙ্গগুণে আমাদের চিন্তা-চেতনায় জং ধরে। এই গুণ বড় বিচিত্র। মস্তিষ্কের জানালা-দরজা সব বন্ধ করে দেয়। তখন আমরা ভীষণ খর্ব হই, ক্ষুদ্র হই। একটু বুঝতেও পারিনা কোথায় যাচ্ছি। তখন ভালো কিছু করা বা বলা ঐ জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসি আরকি! সব নিষ্ফলা। বস্তুগত লাভ হবে, ভাবের ঘরে থাকে বিদঘুটে অন্ধকার।


নীলকণ্ঠ কবি নজরুল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ও আত্মমর্যাদাবান যুগমানব ছিলেন। তাঁর পক্ষেই এমন হাসি সম্ভব। এই হাসির পেছনে রয়েছে এক গভীর দার্শনিক তত্ত্ব।

“আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি” - এ তো সহজ নয়! গভীর প্রতীকী ও দার্শনিক চিন্তার অভিব্যক্তি, যা কবির অন্তর্জগতের দহন এবং বাহ্যিক প্রশান্তির দ্বৈত বাস্তবতাকে একত্রে ধারণ করে। “জাহান্নামের আগুন” এখানে ধর্মীয় নরকের চিত্র নয়, বরং অবক্ষয়, নৈতিক অধঃপতন, কূপমণ্ডূকতা, ভয়, মিথ্যার বেসাতি, মানসিক বেদনা, আত্মগ্লানি, অস্তিত্বের নিরর্থকতা থেকে উদ্ভূত এক চরম অন্তর্জ্বালার রূপক। যেখানে ব্যক্তি নিজেকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করায়।


এই পঙ্‌ক্তির প্রকৃত গভীরতা নিহিত এর দার্শনিক দ্বন্দ্বে: কবি এমন এক অবস্থায় উপনীত হয়েছেন যেখানে যন্ত্রণা আর আনন্দ, দহন আর সৌন্দর্য, আত্মবিনাশ আর আত্মনির্মাণ এক হয়ে যায়। এটি আরেক অর্থে আত্মসংযমের রূপক, যেখানে ব্যক্তি যন্ত্রণার মুখেও নিজের মানসিক ভারসাম্য ও আত্মমর্যাদা রক্ষা করেন; আবার অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে এটি জীবনের অর্থহীনতা ও যন্ত্রণাকে নিজের ভিতর গ্রহণ করে তা থেকেই অর্থ ও সৌন্দর্য নির্মাণের প্রচেষ্টা — একধরনের সচেতন মানবিক প্রতিবাদ। সেই পুষ্পের হাসির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে মানবিক আত্ম-জিজ্ঞাসা, দার্শনিক নৈঃশব্দ্য ও এক অনন্য নান্দনিকতা। তবে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যা-ই হোক বাস্তবে এ হাসি বড্ড কঠিন এবং অর্থহীন। হাসলেই কি আর কাঁদলেইবা কি! কার কি আসে যায় তাতে! তাকাবার সময়তো নাই! বরং লাভলোকসানের হিসেবটাই মুখ্য। তাই সবসময় সবখানে সন্তুষ্টি নিয়ে পুষ্পের হাসি দিলে কাজ হবেনা। বরং আগুন আমাকেই গ্রাস করবে।


খাঁটি কথা হচ্ছে, সাতমণ খাঁটি দুধকে একফোঁটা গোমূত্র নষ্ট করে দেয়, কিন্তু উল্টোটা কখনো হয়না। এখন আপনার খাঁটি দুধের আয়োজনে গোমূত্রও রাখবেন কিনা সেটা আপনার বোধ, বিবেচনা, বিচক্ষণতা, সাংস্কৃতিক মান, সততা, আপনার সাধনার উপলব্ধির উপরই নির্ভর করে। আত্মশ্লাঘা লাভের কোনো সুযোগ নাই। সেই নিষ্ফলা হাসি! কারন আপনি দুধের সাথে চনাও নিয়েছেন(চেনা বা গোমূত্র)। টিকির সাথে বাতাসাকে মিশিয়েছেন। টিকি সারাজীবন টিকি। টিকি বাতাসা হয়না, হতে পারেনা।


এখন সমাজে তাই কোনো আইডল নেই, অবলম্বন নেই। ভালো বলতে যাকিছু আছে তা নীরবে নিভৃতে টিকে আছে। যুগের দাবীতে নজরুল আগুনকে অগ্রাহ্য করেছেন যে সত্যের উদ্বোধনে, আত্মার শক্তিতে সেই সাহস ও শক্তি এযুগে আমার আপনার নেই।


এ সমাজ এখনো লালনকে বুঝেনি। তাঁর 'প্রসাদবাণী' না বুঝে তাকে কিকরে কি বানানো যায় এটাই আমাদের মগজের ধন। শত শত নিপাট সরল সহজ সফেদ লোককবির পদ বুঝেনি এ সমাজ। এঁদের গান আর আমাদের 'ফান' সমান এক হয়ে গেছে এখন।


বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী শিক্ষিকা, বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আসা, সুশ্রী আধুনিকা মহিলা বলেছেন- রবীন্দ্রনাথ নাকি শুধু উনার প্রকৃতি পর্যায়ের গানে সার্বজনীন, মানে সবার হতে পেরেছেন। আর নয়তো ধার্মিক ভাবধারা নিয়েই তাঁর গান গাওয়া হয়। হিন্দুরা সেটা করেন। -- এইতো আমাদের বিদ্যা আর জ্ঞান, আমাদের সামষ্ঠিক মান, গভীরতা, উপলব্ধি! সুতরাং এখানে ১১ জ্যৈষ্ঠ, ২৫ শে বৈশাখ, ২২ শে শ্রাবণ আর দোল পূর্ণিমায় লালনের আখড়াবাড়ির ভক্তিবিহ্বলতা কি এমন প্রভাব ফেলে! এতো সেই পুষ্পের হাসি!


গঙ্গা সিন্ধু নর্মদায় যেমন অবিরাম জল প্রবাহিত হচ্ছে তেমনি পদ্মা মেঘনা যমুনা সুরমাতেও অনেক জল গড়িয়ে গেছে। কতো শাসক শোষক রাজা উজির চলে গেছেন। তবু মানুষ টিকে আছে, সাধারণ মানুষ, রক্তমাংসের মানুষ। আমাদের সর্বনাশ হচ্ছে, এখন সেই মানুষও আর মানুষ নাই! মানুষও চলে যাচ্ছে, বানের জলের মতো, সব মানবিক মানুষ! এখন পুষ্পের হাসি কি ফেরাতে পারবে সোনার মানুষকে?

কতো বিদগ্ধজনা রস অনুমানই

অনুভব কাহুখনা পেখ,

বিদ্যপতি কহে পরাণ জুড়াইতে

লাখে না মিলল এক।।

তাহলে, সমাধান কি? সমাজ পাল্টাবেনা? সাধের মানবসমাজ কি সৃজন হবেনা? হবে নিশ্চয়।

"চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানিচ সুখানিচ।"


লেখক ও প্রামাণ্যকার

নীরব চাকলাদার

মন্তব্য করুন:

Post Bottom Ad
Sidebar Top Ad
Sidebar Botttom Ad