ইতিহাস ও ঐতিহ্য : মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলা
Post Top Ad

ইতিহাস ও ঐতিহ্য : মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলা

প্রথম ডেস্ক

০৩/০৬/২০২৫ ০৯:৪১:০৮

প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না: ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

ইতিহাসে এক সমৃদ্ধ জনপদের নাম সিলেট। এই সিলেটে একদিকে যেমন পরশ রয়েছে অলি-আওলিয়ার, অপরদিকে রয়েছে দেশ বরেণ্য গুনী ও কীর্তিমান মানুষ। কেউবা কর্মক্ষেত্রে,কেউ পেশায়, কেউ মেধা, কেউ অনন্য সাধারণ কীর্তির জন্য বিশ্ব দরবারে মহিয়ান করেছেন সিলেটকে। এছাড়া ঐতিহ্যগত ভাবেও সিলেটবাসীর রয়েছে একটি সোনালী অধ্যায়। সিলেট বিভাগের প্রতিটি জেলা ও উপজেলার রয়েছে আলোকিত ইতিহাস-ঐতিহ্য। তারই ধারাবাহিকতায় আজ মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য তোলে ধরা হলো। যে কেউ নিজ নিজ জেলা ও উপজেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য আমাদের পাঠাতে পারেন। আমরা যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে তা প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 


রাজনগর

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার একটি ঐতিহাসিক জনপদ রাজনগর। এর উত্তরে সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলা ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা,পূর্বে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলা, দক্ষিণে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা ও কমলগঞ্জ উপজেলা, পশ্চিমে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা। প্রাচীন যুগে রাজনগর এলাকাটি কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো এবং মধ্যযুগে মোঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। রাজনগরের মাটি বহু গর্বিত সন্তানের জন্ম দিয়েছে। ১৪০ টি গ্রাম নিয়ে এই উপজেলার আয়তন ৩৩৮.১৫ বর্গ কিঃ মিঃ। জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ২,৩২,৬৬৬ জন (সর্বশেষ আমদশুমারী অনুযায়ী)। এখানে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন উপজাতী সম্প্রদায় বাস করেন। সবার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময় সমাজ। উপজেলায় কলেজ রয়েছে ৫টি, ২৫টির বেশি মাদ্রাসা ৩০টির বেশি হাই স্কুল প্রায় ১৩৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। উপজেলায় মসজিদের সংখ্যা-৩৩৮ টি, ঈদগাহ- ১৮২ টি, মন্দির- ২৭ টি, গোরস্থান- ৯৫ টি, শশ্মান- ২১ টি।


উপজেলার নামকরণ ও ঐতিহাসিক পটভূমি:

১১৯৫ সালে ত্রিপুরার রাজা এক ধর্মযজ্ঞ আয়োজন করেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতের কনৌজের ‘ইটোয়া’ নামক স্থান থেকে নিধিপতি শর্মাকে আনা হয় সেই যজ্ঞের কাজ সুসম্পন্ন করার জন্য। নিধিপতি সে দায়িত্ব সুচারুরুপে পালন করার পর মহারাজা খুশি হয়ে তাকে ‘মনুকূল’ নামক বিশাল ভূখন্ড দান করেন। পরবর্তীতে নিধিপতি ইটোয়ার অধিবাসী হওয়ায় মনুকূল স্থানের নাম রাখেন ‘ইটা রাজ্য’। নিধিপতি বাস করতেন ভূমিউড়া গ্রামে। 


তাঁরই পরবর্তী বংশধর ১.ভানু নারায়ন ২.ইন্দ্র নারায়ন ৩.ভানুমতি।১৫৪৫ খ্রি.ভানু নারায়ন ত্রিপুরার রাজা বিজয় মানিক্যর এক বিদ্রোহী সর্দার চন্দ্র সিংহকে পরাজিত করেন ও বন্দী করে মহারাজের নিকট প্রেরণ করেন। মহারাজ খুশি হয়ে ভানু নারায়নকে ‘রাজা’ উপাধি দান করেন।ভানু নারায়নই তাঁর রাজধানী ভুমিউড়া থেকে স্থানান্তর করেন ও এই এলাকার নাম রাখেন “রাজনগর”।ভানু নারায়নের ৫পুত্র – ১.সুবিদ নারায়ন ২.ব্রহ্ম নারায়ন ৩.ধর্ম নারায়ন ৪. বীরচন্দ্র নারায়ন ৫.রুপ নারায়ন।ভানু নারায়নের উত্তরাধীকার ‘সুবিদ নারায়নই’ ইটা রাজ্যের শেষ হিন্দু রাজা। ১৫৯৮ সালে খাজা ওসমানের সাথে এক যুদ্ধে সুবিদ নারায়ন পরাজিত ও নিহত হন। ভানু নারায়নের অপর উত্তরাধীকারী বন্দী হন ও পরবর্তীতে ধর্মান্তরিত হন।


ঐতিহাসিকেরা ধারণা করেন সিলেটি নাগরী সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল এই রাজনগর।মহাকবি শাহ শেখ চান্দ এবং মধ্যযুগের খ্যাতনামা কবি সৈয়দ শাহনুরের জন্ম রাজনগরে।নাগরী সাহিত্যের প্রাণপুরুষ সৈয়দ সাদেক আলীর মাজার রয়েছে মনসুরনগরের তাহারলামু গ্রামে। রাজনগর দুটি শব্দ, রাজ এবং নাগর, যার অর্থ "রাজার শহর" থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এটি সম্ভবত প্রাচীন ইটা রাজ্যের রাজাদের উল্লেখ করে যেখানে রাজনগর ছিল রাজধানী। রাজনগরকে রাজার ভূমিও বলা হয়ে থাকে। একটি কথা এলাকায় বহুল প্রচলিত রাজার ভূমি রাজনগর, রাণী মোদের কমলা।


সিলেট শহরের ক্বিনব্রিজের নীচে যে ঐতিহাসিক‘সারদা হল’ আছে তার সাথে রাজনগরের এক মহান ব্যাক্তির স্মৃতি জরিত। ‘শ্রী সারদা চরণ শ্যাম ‘রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ গ্রামের লোক ছিলেন। প্রথম সিলেটি হিসাবে ১৮৯৬ সালে তিনি ‘ইন্দেশ্বর টি এন্ড ট্রেডিং কোম্পানির’ মাধ্যেমে বাঙালীদের মধ্য থেকে চা চাষের উদ্যোগ নেন। ব্রিটিশ আমলে রাজনগর থানা হিসাবে ছিল। ১৯৮৪ সালে উপজেলায় উন্নীত হয়।


ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থান:

কমলারাণীর দীঘি(সাগর দীঘি): রাজা ভানুরায়ের রানির খনন করা, ইতিহাসবাহী একটি দিঘী। রাজনগর-ফতেহপুর রাস্তায়,রাজনগর বাজার থেকে ৩কি.মি. দূরে অবস্থিত।মূল সড়ক সংলগ্ন হওয়ায় সহজে গমনযোগ্য।বাস,টেম্পু,মটরসাইকেল,রিক্সাযোগে যাতায়াত করা যায়।


জলের গ্রাম অন্তেহরি মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার ১ নং ফতেপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। রয়েছে মাথিউড়া চা বাগান লেক, উপজেলা সদর থেকে ৪ কি.মি. উত্তরদিকে টেংরা বাজার যা রাজনগর-কুলাউড়া রাস্তার উপর অবস্থিত। বাজার থেকে পশ্চিমপার্শ্বে মাথিউড়া চা বাগান।বাগানের প্রবেশদ্বার থেকে আরও প্রায় ২ কি.মি.ভেতরে কাউয়াদিঘী: জীববৈচিত্র্যে ভরপুর একটি প্রাকৃতিক জলাধার, পাখির অভয়াশ্রম।


উপমহাদেশের প্রথম নারী রাজবন্দি লীলা নাগের জন্ম :

উপমহাদেশের প্রথম নারী রাজবন্দি লীলা নাগের জন্ম রাজনগর উপজেলার পাঠানপাড়ায় ১৯০০ সালে। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী শিক্ষার্থী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাহসী কর্মী। নারী শিক্ষা, সমাজ সংস্কার ও স্বাধীনতার পক্ষে আমৃত্যু লড়েছেন। ১৯৩২ সালে তিনি উপমহাদেশের অন্যতম প্রথম নারী রাজবন্দি হন। তাঁর জীবন রাজনগরের ইতিহাসে অনন্য উচ্চতায় অবস্থান করে। তাঁর নামে স্থায়ী স্মৃতিচিহ্ন প্রতিষ্ঠা এখনও অপেক্ষমাণ।


নদ-নদী

রাজনগর উপজেলার উত্তর পাশে রয়েছে মনু নদী এবং এর দক্ষিণ সীমায় রয়েছে কুশিয়ারা নদী। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কোন নদী নেই। তবে এ উপজেলায় অসংখ্য খাল ও ছড়া রয়েছে।


অর্থনীতি: কৃষি, চা ও প্রবাসে গড়া সমৃদ্ধি

ধান, সবজি ও মাছচাষ রাজনগরের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির মূলভিত্তি। এখানে রয়েছে ১৩টি চা-বাগান।

চা-শিল্প স্থানীয় কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখছে।বহু মানুষ প্রবাসে—বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে—কর্মরত। প্রবাসীদের আয় অবকাঠামো ও সামাজিক উন্নয়নে সরাসরি প্রভাব ফেলছে।


রাজনীতি ও প্রশাসন

রাজনগর বর্তমানে মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) আসনের অন্তর্ভুক্ত। একসময় এটি ছিল একটি স্বতন্ত্র সংসদীয় এলাকা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এখান থেকে জয়ী হন ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন চৌধুরী। সর্বশেষ সংসদ সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান (আওয়ামী লীগ), যিনি ২০২৪ সালের আওয়ামী লীগ সরকার পতনপর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।


উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন:

ফতেপুর # উত্তরভাগ # মুন্সিবাজার # পাঁচগাঁও # রাজনগর # টেংরা # কামারচাক # মনসুরনগর।

 

কীর্তিমানদের তালিকা

লীলা নাগ – নারী শিক্ষার পথিকৃৎ, রাজনীতিক ও সমাজসংস্কারক

ড. মুমিনুল হক চৌধুরী, রাজনগর সদর (ইতিহাসবিদ) , রাজনগর।

ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ (অর্থনীতিবিদ) , পাঁচগাঁও, রাজনগর। – অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশ আন্দোলনের নেতা।

মোঃ আহাদ চৌধুরী (সাবেক কমান্ডার, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা সংষদ), টেংরা, রাজনগর।


নীরব চাকলাদার

মন্তব্য করুন:

Post Bottom Ad
Sidebar Top Ad
Sidebar Botttom Ad