সিলেটের পাথর কাণ্ড : যে তথ্যগুলো এখনও অজানা

পাথর কাণ্ডের ঘটনায় সরগরম মিডিয়াপাড়া। এই আলোচনা আগে ছিল না, এমনটিও নয়। তবে লুটপাট মহোৎসব পর্যায়ে চলে যাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশি সরব হয়ে উঠে। কমতে থাকে পর্যটক। মোদ্দা কথা, সাদাপাথরের রাজ্য যখন পাথরশুন্য অবস্থায়, তখনই কিছুটা বেকায়দায় পড়ে প্রশাসন। পরিস্থিতিগত কারণে অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুদক টিম। মাঠ পর্যায়ে তদন্ত শেষে একটি প্রতিবেদন জমা হয়। প্রতিবেদনে রাজনীতিবিদসহ প্রভাবশালী ৪২ ব্যক্তির নাম উঠে আসে। এর মধ্যে রয়েছে অঙ্গসহযোগী সংগঠনসহ তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের নাম। দুদকের এই প্রতিবেদনের পর তোলপাড় শুরু হয় সিলেটে। ২০ আগষ্ট এই তদন্ত প্রতিবেদনের দিনই সিলেট মহানগর বিএনপি নিজেদের অবস্থান ব্যখ্যা করে সিলেটে সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে দুদককে তার প্রমান তোলে ধরার আহবান জানানো হয়। পরদিন ২১ আগষ্ট একই পথে হাঁটে জামায়াতে ইসলাম ও এনসিপি। তাঁরাও সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পাথরকাণ্ডে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। একই সাথে ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার হীন উদ্দেশ্য বলে দুটি সংবাদ সম্মেলনেই অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
ঘটনার শুরুটা যেভাবে
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ,ভোলাগঞ্জ, জাফলং,বিছনাকান্দিসহ পাথর কোয়ারি ও বালুমহালের প্রতিটি স্থানে লুটপাটের ঘটনা নতুন নয়। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের পর লুটপাট রীতিমতো মহোৎসবে রূপ নেয়। বেশি আলোচনায় আসে ভোলাই নদীর দক্ষিণ বালু মহাল ইজারার পর। চলতি বছরের ২১ জুলাই এই বালুমহালটি বার্ষিক ৬ কোটি ৭৫ লাখ ৫০ টাকায় চুক্তি সম্পাদিত হয়। শর্ত অনুযায়ী ধলাই নদীর ২১৭ দশমিক ৭০ একর জায়গার ইজারা পায় মেসার্স ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আব্দুল্লাহ আল মামুন। বালু মহালের শর্ত ভঙ্গ করে দক্ষিণ বালু মহালে তখন চলছিল বালু উত্তোলন। একই সাথে ইজারা বহির্ভুত স্থান থেকেও সংগ্রহ শুরু হতে থাকে বালু ও পাথর। ইজারা প্রাপ্তির সুযোগে সাদাপাথর এলাকায়ও নজর পড়ে এই চক্রের। এরপর জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদের সাথে অলিখিত চুক্তির পর বালু এবং পাথর লুটের মহোৎসব শুরু হতে থাকে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন উৎসবযজ্ঞের মূল মেকিংম্যান। সবকিছু চূড়ান্ত হবার পর ইজারাদার পক্ষের লোকজন প্রতি ঘনফুট বালু পাথরে লোভনীয় অফার দিয়ে এই কাজে যুক্ত করে নেন হাজারো শ্রমিক। মূলত বালুর সাথে পাথর লুট বিস্তৃত হয় সাদাপাথর পর্যন্ত। এর সাথে যুক্ত শুধু রাজনীতিবিদরাই নন, ছিলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সাংবাদিকবৃন্দ। ফলে বালু পাথর উত্তোলন চলে বেপরোয়া ভাবে। এতে করে ধলাই নদীর সেতুটি পড়ে ঝুঁকির মুখে। তখন স্থানীয় কিছু মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠে। তারা সেতু বাঁচাতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি দিতে থাকেন। তাদের ব্যানারে সরাসরি এর জন্য যুবদল নেতা মকসুদ আহমদ ও আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল ওদুদ আলফুকে দায়ী করা হয়। ১১ আগষ্ট ধলাই ব্রিজে বেলা ১ ঘটিকায় এই মানববন্ধন সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আলমগীর আলম চেয়ারম্যান এবং সভাটি পরিচালনা করেন মাস্টার নিজাম উদ্দিন। মানববন্ধন সমাবেশের ৫ ঘন্টার মধ্যেই ওইদিনই কেন্দ্রীয় নির্দেশে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি সভাপতি মো. সাহাব উদ্দিনের দলীয় পদ স্থগিতের ঘোষণা আসে। তারপর প্রকাশ্যে মুখ খুলতে থাকেন মো. সাহাব উদ্দিন। তিনি প্রকাশ্যে এ ঘটনার জন্য জেলা যুবদলের শীর্ষ কয়েক নেতার নাম উল্লেখ করেন। এর পরদিন ১২ আগষ্ট সিলেট থেকে সকল গণমাধ্যমের (টিভি,প্রিন্ট,অনলাইন) সংবাদকর্মীরা সাদাপাথর রাজ্য পরিদর্শনে যান। ওইদিন থেকেই ঢালাওভাবে বিশদ বর্ণনায় সাদা পাথর ও বালু মহালের ইতিবৃত্ত আসতে থাকে। তবে সাহাব উদ্দিনের পদ স্তগিত হওয়ার পরদিন ১২ আগষ্ট গোটা কোম্পানীগঞ্জে ছিল পিন পতন নীরবতা। না ছিল ধলাই নদী থেকে বালু উত্তোলন, না ছিল সাদা পাথর স্পটে পাথর সংগ্রহে ব্যবহৃত কোন নৌকা।
- উল্লেখ্য, অনলাইন গণমাধ্যম ‘প্রথম সিলেট.কম’ কোম্পানীগঞ্জে টাক্সফোর্সের অভিযানে জব্দকৃত পাথর পাচারের একটি ভিডিও চিত্রসহ সংবাদ প্রকাশ করে ১৬ আগষ্ট। যেখানে বলা হয়, ওইদিন সন্ধা থেকে তুহিন এ্যান্ড বশির কোম্পানী’তে যৌথবাহিনীর অভিযান চালিয়ে জব্দকৃত পাথর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ইউএনও;র যৌথ উদ্যোগে তোলে দেয়া হচ্ছে স্টিল বডি ইঞ্জিন চালিত নৌকায়। পাথর লোডকৃত নৌকার নাম মেসার্স জে কে নৌ পরিবহন। রাত ৯ টায় এই সংবাদ প্রকাশের পরই রাত ১১ টার দিকে সিলেটের জেলা প্রশাসন ঘটনাস্থল কোম্পানীগঞ্জ পরিদর্শনে যান। তবে এর আগেই স্টিল বডি নৌকা পাথর লোড নিয়ে চলে যেতে সক্ষম হয়।
দৃশ্যান্তর এবং কিছু প্রশ্ন :
কোম্পানীগঞ্জে কর্মরত সংবাদকর্মীদের দুইটি ক্লাব রয়েছে। ক্লাব দুটোতে অনেক সিনিয়র সংবাদকর্মীরা যুক্ত আছেন। ক্লাব দুটোতেই জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় যুক্ত থাকা সংবাদ কর্মীরা রয়েছেন। ১১ আগষ্ট ধলাই নদীর সেতু রক্ষা কমিটির ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধন সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু সেই খবর ওইদিন কোন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় নি। প্রশ্ন-স্থানীয় প্রতিনিধিরা এই সংবাদ কি পাঠায় নি ? উত্তর যদি ‘হ্যা’ হয় তাহলে বিষয়টি বোঝে নিতে দেরি হবে না। আর যদি ‘না’ হয়, তাহলে ক্লাব দুটোতে যুক্ত থাকা কর্মরত সংবাদকর্মীদের নৈতিকতার জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না কেন? পাথর লুট কাণ্ডের বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ প্রেসক্লাবের একটি অংশের সভাপতি রূপালী বাংলাদেশের সিলেটে ব্যুরো’র এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পাথর লুটে গণমাধ্যমে যাদের নাম এসেছে, তাঁরা সকলেই সম্মানিত লোক। তাঁরা এই লুটপাটে জড়িত নয়। পাথর লুট করছে শ্রমিকেরা।’ ক্লাব সভাপতির এই বক্তব্য সঠিক হলে, সকল গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদগুলো মিথ্যা হয়ে যায়। যারা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে সংবাদ প্রকাশ করলো, তাদের সকলেই তাহলে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করলো। দুটি কখনো একসাথে সত্যি হতে পারে না। হয় কোম্পানীগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতির বক্তব্য সত্য না হয় সকল গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সত্য।
ধরে নিলাম ওই সিনিয়র সংবাদকর্মী সত্য বলছেন। তাহলে প্রশ্ন রাখা দরকার-একজন সংবাদকর্মী হিশেবে শ্রমিকদের পাথর লুট নিয়ে ওই সভাপতি কী কোন সংবাদ প্রকাশ করেছেন? একই সাথে প্রশ্ন রাখা দরকার-তিনি স্থানীয় কোন পত্রিকার প্রতিনিধি এবং জাতীয় কোনটিতে কাজ করেন? সেই পত্রিকাগুলোতে পাথর লুটপাট নিয়ে সভাপতির কোন নিউজ প্রকাশ হয়েছে কি না? যদি প্রকাশ হয়ে থাকে, রূপালী বালাদেশে তার বক্তব্য এমনটি হবার কথা না। তিনিনছাড়া কোম্পানীগঞ্জে বিভিন্ন স্থানীয়,জাতীয় প্রিন্ট পত্রিকার পাশাপাশি অনলাইন গণমাধ্যমে কাজ করা অনেক সংবাদকর্মী রয়েছেন। পাথর লুটপাট ঘটনায় সংবাদ প্রকাশে তাদের ভূমিকা কতোটুকু,সেটিও আলোচনায় আসা দরকার। দুটি প্রেসক্লাবকে তদন্তের আওতায় নিয়ে আসলে সিলেটের সংবাদকর্মীদের সখ্যতার তথ্যটি পাওয়া যাবে খুব সহজে (যদি এমনটি হয়ে থাকে)। তদন্তে সংবাদ কর্মীদের সখ্যতার বিষয়টি প্রমানীত না হলে সংবাদকর্মীদের প্রতি মানুষের নির্ভরতা এবং বিশ্বাস বহাল থাকবে। কিন্তু উল্টো চিত্রে মানুষ পেশা নিয়ে কটুবাক্য দিতেও কুণ্ঠিত হবেন না।
তদন্ত প্রতিবেদনে ৩ টি রাজনৈতিক দলের নাম
রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধনের অভিযোগে গত ১৩ আগস্ট সিলেটের সাদা পাথর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে দুদক। অভিযানে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পাথর আত্মসাতের প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ও সুবিধাভোগী সংস্থা ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ব্যক্তিবর্গের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন- আজিজুন্নাহার, মোহাম্মদ আবুল হাছনাত, উর্মি রায়, আবিদা সুলতানা। এ ছাড়াও রয়েছে পুলিশ সুপার, অফিসার ইনচার্জ, বিজিবি ও ব্যবসায়ীসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তালিকাটি প্রকাশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তালিকায় ৪২ জন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নাম রয়েছে। তালিকায় বিএনপি, এনসিপি,জামায়াত ও যুবদলের নেতৃবৃন্দের নাম উল্লেখ করা হয়। তবে দুদকের এই প্রতিবেদনে নড়েচড়ে বসে অভিযুক্ত ব্যক্তিসহ তিনটি রাজনৈতিক দল। প্রত্যেকেই দুদকের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে প্রশাসনে জড়িত থাকাদের আড়াল করার চেষ্টা,হীন উদ্দেশ্যে অথবা কারো উদ্দেশ্য সার্ভ করার জন্যই এমন প্রতিবেদন ইত্যাদি।
যে প্রশ্নের জবাব নেই
এখন প্রশ্ন হলো, ওএসডি হওয়া সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ বলেছেন, পর্যটন রক্ষা করতে গিয়ে ঘটনার শিকার হলাম। অভিযুক্ত রাজনীতিবিদরা বলছেন, এই অভিযোগ ভুয়া এবং দুদককে তা প্রমাণ করতে হবে। স্থানীয় সংবাদ কর্মীদের নেতা বলছেন, পাথর লুট করছেন শ্রমিকরা। আবার উপজেলা বিএনপির পদ স্তগিত হওয়া সভাপতি সাহাব উদ্দিন বলছেন তিনি ধোয়া তুলসী পাতা। জেলা যুবদল সাধারণ সম্পাদক ও চেয়ারম্যান আলফু এই ঘটনার জন্য দায়ী।
প্রশ্ন জাগে-জাফলংয়ে যখন জেলা প্রশাসনের অভিযানে স্টোন ক্রাশার মিলের বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, যখন পাথর ও বালু বোঝাই নৌকা ডুবিয়ে দেওয়া হয়, যখন বুলডোজার মেশিন জব্দ করা হয়,যখন এসব ঘটনায় গণমাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠতে থাকে, তখন রাজনীতিবিদরা কেন এই অভিযানের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করলেন? তাদের সেই যুক্তি কতোটুকু গ্রহণযোগ ছিল। সিসিকের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী তখন ঝলসে উঠলেন জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে। একই সাথে জামায়াতে ইসলাম, বিএনপি এবং এনসিপিও অভিযান বন্ধ করে বরং শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের জন্য অভিযান বন্ধ রাখার আহবান জানান। কিন্তু সাদা পাথর রাজ্য যখন বিরান ভূমিতে রূপ নিল তখনই বা তাদের স্পষ্ট অবস্থান কিংবা প্রতিরোধ কেন দেখলাম না ?
- প্রশ্নগুলো উঠতে হবে, মেলাতে হবে উত্তর,বাচাঁতে হবে প্রকৃতি, বাঁচাতে হবে পরিবেশ। সর্বোপির বাঁচতে হবে সিংহের মতো,শেয়ালের মতো নয়।
নীরব চাকলাদার

মন্তব্য করুন: