সাদা পাথর রাজ্যে কালো নাম ‘আলফু’
Post Top Ad

সাদা পাথর রাজ্যে কালো নাম ‘আলফু’

নীরব চাকলাদার

০৪/০৯/২০২৫ ০৮:১৭:০৪

প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না: ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

বালু-পাথর সাম্রাজ্য সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে এক আলোচিত নাম কাজী আবদুল ওয়াদুদ আলফু মিয়া। সাদাপাথর লুটপাটসহ ধলাই নদীর বালুকাণ্ডেও এই নামটি বারবার উঠে এসেছে আলোচনায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি ছিলেন বালু পাথর সাম্রাজ্যের দোর্দণ্ড প্রতাপশালি ব্যক্তি। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এই প্রতাপশালি ব্যক্তি উপজেলার ৩ নং তেলিখাল ইউনিয়ন পরিষদের একজন চেয়ারম্যান। জন প্রতিনিধি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের পদে থাকায় তিনি গড়ে তোলেন এক বিশাল বাহিনী। এই বাহিনী স্থানীয় ভাবে ‘আলফু বাহিনী’ নামে পরিচিত। আলফু বা আলফু চেয়ারম্যানের দল আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতাহীন। তবে ৫ আগষ্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও আলফু বাহিনী এখনও দাপট দেখাচ্ছে বালু-পাথর সাম্রাজ্যে। কোম্পানীগঞ্জে বালু পাথরের রাজ্যে এক কালো নাম এখন আলফু। 


৫ আগষ্টে রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তন হলে কৌশল পরিবর্তন করে নেন আলোচিত কাজী আবদুল ওয়াদুদ আলফু মিয়া। বিএনপি নেতাদের কাধে ভর করে ফের পাথর সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। বিগত দিনে পৃথক ঘটনায় আলফু চেয়ারম্যানের নামে মামলা রয়েছে অন্তত ৭ টি। তবুও অধরা তিনি। চলতি বছরের জুলাই মাসে নিজের বায়রা ভাই ‘ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ’ এর নামে ধলাই নদীর দক্ষিণ পাড়ে বালু মহাল ইজারা গ্রহণ করেন। ইজারা গ্রহণের পর আলফু বাহিনী প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়ে উঠে কোম্পানীগঞ্জে। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে চলে বালু উত্তোলন। বালু উত্তোলনের তাণ্ডবযজ্ঞে ধলাই নদীর সেঁতু হয় ঝুঁকিপূর্ণ। এর জের ধরে ধলাই সেঁতু রক্ষায় গঠন করা হয় একটি কমিটি। ধলাই নদীর অস্থিত্ব ও সেতুঁ রক্ষায় নানা কর্মসূচী চলে। একই সাথে বালু তাণ্ডবের হাত থেকে সেঁতু রক্ষায় প্রতিবাদ কর্মসূচী গ্রহণ করে পরিবেশবাদী সংগঠন। কিন্তু বিএনপি নেতাদের প্রশ্রয়ে আলফু বাহিনী সবকিছু মানিয়ে নিলেও মেনে নিতে চায় নি। এই ঘটনার জের ধরে প্রতিবাদকারীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকী ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হয়। একই সাথে দলীয় পদ স্থগিত করা হয় উপজেলা বিএনপি সভাপতি ও পাথর লুটের অপর নায়ক সাহাব উদ্দিনের।


এদিকে কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর, সংরক্ষিত বাংকার এলাকা, ভোলাগঞ্জ কোয়ারি ও শাহ আরেফিন টিলা এলাকায় পাথর লুট 'ঠেকাতে না পারায়' সিলেটের তৎকালনি ডিসি, ইউএনও ও ওসি সমালোচিত হন। সাদাপাথর থেকে সম্প্রতি অন্তত ৮০ শতাংশ পাথর লুট হওয়ায় তারা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে তাদের বদলি করা হয়। অবশেষে নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে সিলেটে যোগ দেন সারওয়ার আলম। নতুন জেলা প্রশাসক যোগদান পরবর্তী পাথররাজ্যে শুরু হয় অভিযান। একই সাথে চলে লুণ্ঠিত পাথর উদ্ধার কার্যক্রম। ২৬ আগষ্ট সিলেটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জেলা প্রশাসকের একটি অফিস আদেশ জারি হয়। আদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটন সম্ভাবনা এলাকা হতে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন, সংরক্ষণ, পরিবহন, লুষ্ঠন ও পাচার বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এই অফিস আদেশের ফলে অসাধু ব্যবসায়ী যারা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদা পাথর পর্যটন এলাকা, শাহ আরেফিন টিলা, উৎমা পাথর কোয়ারি এবং বিভিন্ন জনবসতী এলাকা থেকে লক্ষ লক্ষ ঘনফুট বালু অফ সিজনে বেশি দামে বিক্রির আশায় সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন তারা চরম বেকায়দায় পরে যান।

জেলা প্রশাসকের ঘোষণার ৩ দিন পর ২৯ আগষ্ট থেকে নতুন কৌশলে হাজির হয় ‘ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ’। এই সুযোগে উপজেলার আনাচে-কানাচে সংরক্ষিত লক্ষ লক্ষ ঘনফুট অবৈধ বালু বৈধভাবে সরিয়ে নেয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ইজারা গ্রহণকৃত 'ধলাই নদী দক্ষিণ বালুমহাল' এর সীমানা হচ্ছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কালাসাদক ও তৈমুরনগর মৌজার মোট ১৯৯.৩০ একর নদী এলাকা। উক্ত বালু মহাল থেকে একমাত্র নৌকা ছাড়া বালু পরিবহণের আর কোন সুযোগ নেই। বিধি মোতাবেক বালু মহালের সীমানার ভিতরে থেকে ইজারাদার রয়েলটি/টোল আদায় করার কথা। কিন্তু তিনি তা না করে বালু মহালের সীমানা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কের কোম্পানীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতের সাব স্টেশন এবং কোম্পানীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের বিপরীতে বিগত ২৮ আগস্ট'২০২৫ ইং থেকে টোলঘর বসিয়ে প্রতি ঘনফুট বালু ৬ টাকা হারে রয়েলটি নিয়ে চালান/রশিদ দিয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার আনাচে-কানাচে সংরক্ষিত সকল অবৈধ বালু বৈধভাবে পাচারের সুযোগ করে দিচ্ছেন। 

তাদের এই তাণ্ডবের ঘটনায় একদিকে যেমন অবৈধ বালু পাথর বৈধ করার কৌশল হচ্ছে,অপরদিকে ভাঙছে ধলাই নদীর দু’পাড়। বাজার, মসজিদ, স্কুল ও বসতিগুলো এখন বিলীন হবার পথে। এই চক্রের তাণ্ডব প্রতিরোধে গ্রামবাসীরা একজোট। তবে ক্ষমতার দাপট এবং পেশি শক্তির কারণে আলফু বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলার সাহস নেই তাদের। গ্রামবাসীর দাবি-ইজারাদার এবার কৌশল পরিবর্তন করে কাগজের বৈধতা দেখিয়ে ইজারা সীমার বাহির থেকেও দিনে রাতে বালু উত্তোলন করছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ধলাই নদীর তীরবর্তী বাজার, স্কুল, মসজিদ ও মাদরাসাগুলো নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে এবং ইতোমধ্যে ভাঙ্গন বিপর্যয়ে বসতিগুলো হুমকীর মুখে রয়েছে। ধলাই নদী এবং বাজার ও বসতি রক্ষায় ত্বড়িৎ হস্তক্ষেপ কামনা করে সিলেটের জেলা প্রশাসক বরাবরে ২ সেপ্টেম্বর একটি লিখিত আবেদন করেছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মোস্তফানগর গ্রামের মৃত জরু মিয়ার ছেলে মো.শাহ আলম। 

ভুক্তভোগীরা জানান,  ইজারাদারের এই অপকর্মে সহযোগী হিসেবে রয়েছেন তার আপন ভায়রা ভাই ৩ নং তেলিখাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি কাজী আব্দুল ওদুদ আলফু, তেলিখাল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য আকদ্দস আলী ও তার আপন সাত ভাই মশাইদ আলী, রুস্তুম আলী, আলী হোসেন, জমির হোসেন, আলী বকস, আলী আব্বাস ও আলী আমজদ এবং উপজেলার দক্ষিণ বুড়দেও গ্রামের মৃত ইউনুস আলীর পুত্র আমির আলী ও মারফত আলী গং। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বালু উত্তোলন, সংরক্ষণ, পরিবহন, লুণ্ঠন ও পাচার বন্ধে জরুরি ভিত্তিতে তাদের এই অপকর্ম বন্ধ করা একান্ত অপরিহার্য।


কে এই আলফু 

আলফু চেয়ারম্যানের স্থায়ী ঠিকানা সিলেটের দক্ষিন সুরমায় হলেও তিনি দেড় দশক আগ থেকেই এলাকা থেকে বিতাড়িত। আলফু চেয়ারম্যানের অতীত বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং স্থায়ী ঠিকানা নিয়ে নিজের ফেসবুকে একটি লেখা পোস্ট করেন সিনিয়র সাংবাদিক বাবর হোসেন। তাঁর এই পোস্টে আলফু চেয়ারম্যানের স্থায়ী ঠিকানাসহ বিস্তারিত কর্মকাণ্ডের অনেক তথ্য উঠে এসেছে। বাবর আহমদের ফেসবুক পোস্টের সেই লেখাটি হুবুহ নীচে তুলে ধরা হলো। 


ফেসবুক পোস্ট

সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ ৩ নং তেলিখাল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাজী আব্দুল ওয়াদুদ আলফু মিয়া—একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। খুন, অস্ত্র, মাদক ও চাঁদাবাজি—প্রায় সব ধরনের অপরাধে তার নাম জড়িয়ে থাকলেও, তিনি এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাগালের বাইরে রয়ে গেছেন।


স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আলফু মিয়া দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দিতে ২টি খুনের মামলার ১ নম্বর আসামি, কোম্পানিগঞ্জে আরও ১টি খুনের প্রধান আসামি, অস্ত্র ও মাদকসহ অন্তত ১৪-১৫টি মামলার আসামি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রকাশ্যে বন্দুক উঁচিয়ে নেতৃত্বদাতা এবং অস্ত্রের মহড়া, চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সক্রিয় সদস্য।


বিশ্বস্থ একটি সূত্র জানিয়েছে আলফু মাসিক বড় অংকের বখরার বিনিময়ে দক্ষিণ সুরমা থানা, বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের ম্যানেজ করে চলাফেরা করছেন। যে কারণে এখনো তিনি নিজ বাড়ীতে নিরাপদে বিলাসী জীবন- যাপন করছেন। 


আলফুর নিজের আধিপত্য জাহির করার জন্য বড়ইকান্দি এলাকায় এক প্রতিবেশীর সাথে অন্য প্রতিবেশীর বিবাদ লাগিয়ে রাখতেন,  যাতে তিনি বিচার সালিশ করে দাপট দেখাতে পারেন। অথচ ভোটার তথ্য বলছে, তিনি বরইকান্দির নন; তেলিখাল ইউনিয়নের বাসিন্দা। মরহুম কাজী কাচা মিয়ার সৎ ভাই ও বাবার তৃতীয় পক্ষের সন্তান হওয়ায় সম্ভ্রান্ত কাজীবাড়ি তাকে দীর্ঘদিন স্বীকৃতি দেয়নি।তেলিখাল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও ৩ নম্বর রোডের সাথে বিরোধের পর আংশিকভাবে কিছু মানুষ মেনে নিলেও বৃহত্তর অংশ আজও তাকে বর্জন করে।


কাজীবাড়ির এক প্রবীণ সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন“এই বাড়ি গোটা দক্ষিণ সুরমার ঐতিহ্যের প্রতীক, এখানে কাজী তুলা মিয়া বাড়ি বলতে আমরা গর্ববোধ করি—সন্ত্রাসীদের জায়গা নেই।”এছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে পানিপথে আধিপত্য বিস্তার ও অবৈধ চাঁদাবাজির মাধ্যমে আলোচনায় ছিলেন আলফু মিয়া । 


অভিযোগ রয়েছে, নদীপথে চলাচলকারী নৌযান, পাথরবাহী ট্রলার  থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন তিনি। স্থানীয় নৌযান চালকরা জানান, অতিরিক্ত অর্থ না দিলে অনেক সময় নৌযান আটকে দেওয়া হতো বা পাথর খালাসে বাধা সৃষ্টি করা হতো। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা থাকলেও প্রশাসন থাকে গ্রেফতার করছে না।  এতো মামলা থাকার পরও সে বরইকান্দি দশ নং রোডে নিজের বাড়িতে অবস্থান করছে।


আওয়ামীলীগ পালিয়ে গেলেও কাচা টাকার গন্ধ ভূলতে পারছেননা দোসর আলফু। তিনি তাহার বোন জামাই জামায়াতের এক নেতার নামে কোম্পানীগঞ্জের ধলাই সেতুর দক্ষিণ পাশ বালি উত্তোলনের জন্য লিজ নিয়ে রমরমা ব্যবসা করছেন।  সেই সুযোগে কোম্পানীগঞ্জের ওসির সাথে হাত মিলিয়ে নদী পথে তাহার লোক দিয়ে  চাঁদাবাজিতে  বেপরোয়া অবস্থায় আছেন।

তাহির আহমদ

মন্তব্য করুন:

Post Bottom Ad
Sidebar Top Ad
Sidebar Botttom Ad