ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী সিলেটের লীলা নাগ

ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট গীরিশচন্দ্র নাগের চাকুরীর সুবাদে উত্তর-পূর্ব ভারতের অসমের গোয়ালপাড়ায় ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ২১শে অক্টোবর জন্ম হয় লীলা'র । পৈতৃক নিবাস অসমেরই আরেক জিলা শ্রীহট্টের মৌলভীবাজারের রাজনগর থানার পাঁচগাঁও গ্রামে । পারিবারিক নাম ছিল "লীলাবতী"।
লীলাবতীর শিক্ষা জীবন শুরু হয় পূর্ববঙ্গের ঢাক্কার তৎকালীন ইডেন স্কুলে । ১৯২১ সালে যে বছরে ঢাক্কা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়, সেই সালে তিনি কলিকাতার বেথুন কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন । পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং "পদ্মাবতী স্বর্ণপদক" লাভ করেন । ১৯২১ সালে ঢাক্কা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্টা হলে, লীলা নাগ ইংরেজি বিষয়ে এম.এ. ভর্তি হন । ১৯২৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন । উল্ল্যেখ্য যে, তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এম.এ. ডিগ্রীধারী । তখনকার পরিবেশে সহশিক্ষার কোনও ব্যবস্থা ছিল না বলে লীলা নাগের মেধা ও আকাঙ্খা বিচার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চান্সেলর ডক্টর হার্টস তাকে পড়ার বিশেষ অনুমতি প্রদান করেন ।
লীলা নাগ একসময়ে ঢাক্কা কলেজে ও পড়তেন । তার একক্লাস উপরের ছাত্র ছিলেন সাহিত্যিক অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন । লীলা নাগ সম্পর্কে তিনি তার "স্মৃতিকথা" নামক প্রবন্ধ সংকলনে লেখেন, "এর মত সমাজ-সেবিকা ও মর্যাদাময়ী নারী আর দেখি নাই" । এর থিওরী হল, নারীদেরও উপার্জনশীলা হতে হবে, নইলে কখনো তারা পুরুষের কাছে মর্যাদা পাবে না । তাই তিনি মেয়েদের রুমাল, টেবলক্লথ প্রভৃতির উপর সুন্দর নক্সা এঁকে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন । এই সব বিক্রি করে তিনি মেয়েদের একটা উপার্জনের পন্থা উন্মুক্ত করে দেন । বাঙালি নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে তিনি বিশেষ ভুমিকা পালন করেছেন । তিনি ঢাক্কার আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয়, টিকাটুলী'র কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল এবং শের এ বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় (তৎকালীন "নারীশিক্ষা মন্দির") প্রতিষ্ঠা করেন ।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিপ্লবী শ্রীসংঘকে টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক ছুটোছুটি ও প্রচুর পরিশ্রম করতেন লীলা নাগ । বিক্রমপুর পরগণার (অধুনা, মুন্সিগঞ্জ জেলা) রেণু সোম খুব ভালো গান গাইতেন, তখনও সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করে প্রতিভা বসু নামে পরিচিত হোননি । একদিন বিকেলবেলা রেণুর পিতার ঢাক্কার টিকাটুলির বাসায় হাজির হোন লীলা । রেণুকে বলল, 'তোকে এক্ষুনি এক জায়গায় গান গাইতে আমার সঙ্গে যেতে হবে'। প্রিয় লীলা'দির কথা কি রেণু ফেলতে পারে । রেণুকে নিয়ে লীলা হাজির হোল পুরাণ ঢাক্কার নবাব বাড়ীর অন্দরমহলে । সেখানে রেণু নবাব বাড়ীর বেগম, শাহজাদীদের গান শুনিয়ে কিছু টাকা পেল, সেই টাকা লীলা দিয়ে দিল বিপ্লবী শ্রীসংঘকে ।
১৯৩৯ সালে বিপ্লবী শ্রীসংঘের অন্যতম বিপ্লবী অনিল রায়ের সঙ্গে বিয়ের পর লীলা'র নাম হয় শ্রীমতি লীলাবতী নাগ রায় । ১৯৪০ সালে নেতাজীর ফরোয়ার্ড ব্লক গঠনে এই দম্পতি কাজ করে, এবছরই কলিকাতায় হলওয়েল ভাষ্কর্য বিনষ্টের অভিযোগে এই দম্পতিকে গ্রেফতার করা হয় । ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তাদেরকে কারাগারেই অন্তরীণ থাকতে হয় । ১৯৪৬ সালে ভারতের গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হোন লীলা নাগ । স্বাধীনতার নামে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তৎকালীণ মুসলিম লীগের কারনে, নিতান্ত অনিচ্ছাসত্বে লীলা নাগের পরিবার কলিকাতায় চলে যান এবং সেখানেও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন ।
ঢাক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবী নারী এবং বাংলা ভাষায় মহিলা সম্পাদিত প্রথম মাসিক "জয়শ্রী" পত্রিকা'র সম্পাদিকা ছিলেন শ্রীহট্টের লীলা নাগ । (মতান্তরে সুষমা সেনগুপ্তা ছিলেন যুগ্মভাবে ঢাক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী)। নারী অধিকারে সহপাঠীদের নিয়ে গড়ে তোলেন নারীহিতৈষী "দীপালী সংঘ"। লীলাবতী ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর একনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী । লীলাবতী'র তেজোদীপ্ত বৃটিশবিরোধীতার কারনে নেতাজী তাকে ডাকতেন Leo নামে । লীলা নাগ ছিলেন 'ফরওয়ার্ড ব্লক' পত্রিকার ২য় সম্পাদিকা । 'বেঙ্গল ভলেনটিয়ার্স' এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রী হেমচন্দ্র ঘোষের মতে লীলা নাগ হলেন 'আজন্ম বিদ্রোহিণী' । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাবস্থায় লীলা নাগ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও ঋষি অরবিন্দের সান্নিধ্য লাভ করেন । লীলা নাগসহ তার অনেক বান্ধবী-সহপাঠী গোপন বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন । মাষ্টার'দা সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করেন । এরপর ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবী দলের নেতৃস্থানীয়দের গ্রেফতার শুরু করে । শ্রীসংঘের অনিল রায়ও কারাবরণ করেন । ফলে শ্রীসংঘের সর্বময় দায়িত্ব গ্রহন করেন লীলা নাগ । মাস্টারদা সূর্যসেনের পরামর্শে এ সময় অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের প্রথম নারী বিপ্লবী অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, লীলা নাগের কাছে বিপ্লবের জীবন পাঠ বা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন । বিপ্লবী কল্পনা দত্ত ছিলেন লীলা'র অন্যতম অনুজ সহচর । লীলা নাগ ছবি ভালো আঁকতেন এবং গান ও সেতার বাজাতে জানতেন । ১৯৪৬ সালের ১০ই অক্টোবর নোয়াখালীতে হয় প্রচন্ড দাঙ্গা, খবর পেয়ে দ্রুততম সময়ে গান্ধীজী আসেন ভ্রাতৃত্বের আহ্বান নিয়ে । দেশভাগের দাঙ্গার সেই করুণ সময়ে লীলাবতী নোয়াখালীতে গান্ধীজীর সাথে দেখা করেন, এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রান্তিক লোকজনের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃবন্ধনের চেষ্টা করেন ।
দেহভাগের মত দেশভাগে ১৯৪৭ সালের ৭ই জুলাই এক গণভোটে অসম থেকে শ্রীহট্ট বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়, এসময়ে লীলা নাগ রায় ও অনিল রায় দম্পতি পূর্ববঙ্গে বসবাস করার উদ্যোগ নেন । কিন্তু তৎকালীন মুসলিমলীগ শাসকেরা তাঁদেরকে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করে । মূলতঃ ওই সময়েই লীলা নাগ এর মৌলভীবাজার রাজনগরের পৈত্রিক বাড়িটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে । লীলা নাগের বাড়ির সামনের বৈঠকখানা, যেখানে বহু আন্দোলন-সংগ্রামের ভিত রচিত হয়েছে, এ বৈঠকখানাটি আজও তার স্মৃতি বহন করে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় নীরবে দাঁড়িয়ে আছে । ঘরটি অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে দখলমুক্ত করে সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না । টালি'র ছাউনী'র ঘরটির অনেক স্থান খসে পড়ছে । যে কোন সময় শেষ স্মৃতিচিহ্ন বৈঠকখানাটিও ভেঙ্গে যেতে পারে । এখানে বলা প্রয়োজন যে, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সমরাস্ত্র যোগান দাতা হিসেবে পাঁচগাঁও এর 'কর্মকার'গণ স্মরণীয় হয়ে আছেন । উপমহাদেশের অন্যতম কর্মকার 'জনার্দন কর্মকার' মোঘল আমলে মুর্শিদাবাদে 'জাহানকোষা তোপ' নির্মাণ করেন । পরবর্তীতে ঢাক্কায় গিয়ে 'কালে জমজম' ও 'বিবি মরিয়ম' নামে দুইখানা কামান প্রস্তুত করে বৃটিশদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ।
১৯৬৪ সালের ২৫শে মার্চ "পূর্ব-বাংলা বাঁচাও আন্দোলন কমিটি"র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার অপরাধে পুলিশ লীলা নাগ'কে কলিকাতায় গ্রেফতার করে । ১৯৬৬ সালে মুক্তিলাভের পর তিনি শারীরিকভাবে প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়েন । ১৯৬৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সকালে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাকে কলিকাতার পি.জি. হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । টানা ২৩ দিন পর জ্ঞান ফিরে এলেও চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় তাঁর বাকশক্তি । শরীরের ডান অংশ সম্পূর্ণভাবে অচল হয়ে যায় । এ অবস্থায় আড়াই বছর চলার পর ১৯৭০ সালের ১১ই জুন কলিকাতায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা বিপ্লবী লীলাবতী নাগের মহাপ্রয়াণ ঘটে ।
জনকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ লীলা'র পিতৃকুল । পাঁচগাঁও গ্রামে লীলাবতীর বাড়ীর পাশে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তার পিতার দানশীলতায়, লীলাবতীর মায়ের নামে স্থাপিত "কুঞ্জলতা নাগ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়" তারই প্রকৃষ্ট উদাহরন । এলাকাবাসী লীলাবতী নাগের বাড়ীকে চেনে "নাগবাড়ী" নামে, বয়োজ্যেষ্ঠ অনেকে আবার "রায়সাহেব'র বাড়ী" ও বলে থাকেন । সমাজকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ লীলা'র পিতা গীরিশচন্দ্র নাগ পেয়েছিলেন "রায়সাহেব" খেতাব । মৌলভীবাজার সরকারী কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের ছাত্রীনিবাসটি "লীলা নাগ ছাত্রীনিবাস" নামকরণ করেছে ।
ক্ষুদ্র অনুসন্ধানে, সংক্ষিপ্ত পরিসরে লীলা নাগ সম্পর্কে যা কিছু বলা হল তা সিন্ধুতে বিন্দু পরিমাণ, তার বাইরে রয়েছে, আরো ব্যাপক বিস্তৃত ইতিহাস । তবে একথা বলা যায় যে, এ সবকিছু ছাপিয়ে একজন মানবিক লীলা চির জাগরণে থাকবেন চিরকাল । এমন মেধা ও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী লীলা নাগ সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি আজো রাষ্ট্রীয়ভাবে, রাজনৈতিকভাবে । কেন জানি আমরা এদের যথাযথ শ্রদ্ধা জানাতে কুণ্ঠাবোধ করি । হয়ত আগামী প্রজন্ম ইতিহাসের মনি-মানিক্য থেকে তুলে আনবেন লীলাবতী'র লীলা ।
বিধাতার কি বিচিত্র লীলা, বর্তমানে দখলদারদের বসবাসের লীলাভূমি লীলা'র পৈতৃক ঐতিহাসিক বাড়ী । লীলা'র বাড়ীতে বসবাস করছে একাত্তরের কথিত যুদ্ধাপরাধী আলাউদ্দিন চৌধুরীর পরিবার ।
নীরব চাকলাদার

মন্তব্য করুন: