জীবনের সুখদুঃখের ক'টি ছেঁড়া পাতা
Post Top Ad

জীবনের সুখদুঃখের ক'টি ছেঁড়া পাতা

০৭/০৬/২০২৫ ০৫:০৬:৫৯

প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না: ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

জন্মেছি এক রাজ্যহারা রাজপরিবারের একেবারে প্রান্তিক শাখায়। বাবা ছিলেন এক দুর্দান্ত কিশোর ভাষাসৈনিক। তাই মাদারচুত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁকে রাস্টিকেট (Rusticate) করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চশিক্ষা থেকে চিরবঞ্চিত করে দেয়। তাই সরকারি চাকুরি না পেয়ে হালের গরু, ক্ষেতের সামান্যটুকু জমিজমা সব বিক্রি করে আমার মতো এক নরাধম পুত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ালেন। কিন্তু মানুষ বানাতে পারলেন না।


জন্ম আমার রাজবংশে হলেও সোনার চামচ নয়, বাঁশের চামচ মুখে নিয়ে। সাংসারিক অনটন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। বাবার কঠোর নির্দেশনা ছিল-শত প্রতিকূলতা থাকলেও সততা ধরে রাখতে হবে, আত্মনির্ভরশীল হতে হবে, পরমুখাপেক্ষি হওয়া যাবে না, অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথা নত করা যাবে না, ইনফেরিয়র কারও অধীনস্থ হওয়া যাবে না, দীনহীন অসহায় মজলুম মানুষের পাশে হিমালয়ের মতো দাঁড়াতে হবে ইত্যাদি। 


বাবা ছিলেন একাত্তরের দুর্ধর্ষ এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের কোনো সুবিধা নেওয়াকে আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়া জ্ঞান করে সব কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলেন। ছোটখাটো কাপড়ের অলাভজনক ব্যবসা করে সর্বহারা হলেন। মানুষের অভাবে নিজের অভাব ভুলে গিয়ে নিজের বাজারের থলে দান করে দিয়ে খালিহাতে বাড়ি ফিরতেন। মা যে টুশব্দটিও করতেন না, তা নয়, ঝাড়ি দিতে কম করতেন না । প্রয়োজনে আমাদেরকে দু’মুঠো শাকভাত খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। এতোসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাবার রাজসিক আভিজাত্যে একটুও ছেদ পড়েনি। চেইন স্মোকার ছিলেন। টানতেন ট্রিপল ফাইভ (555) ব্রান্ড সিগারেট।

 

অতএব, শৈশব থেকেই আমি নানাবিধ বিপ্লবের সাথে মিতালি পেতে বড় হয়েছি। বাবার শিক্ষায় দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বিপ্লব, অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে বিপ্লব, সততা ও নিষ্ঠার সাথে জীবন যাপনের বিপ্লব, আত্মসম্মান আর আভিজাত্য রক্ষার বিপ্লব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার বিপ্লব, কর্মজীবনে অথর্ব অপদার্থ কতগুলো বসের বিরুদ্ধে  বিপ্লব । জীবনের প্রতিটি স্তরেই শুধু বিপ্লব আর বিপ্লব। এতোসব বিপ্লব করতে করতে আজ আমি প্রায় নিঃস্বই বলা চলে। রিক্ত হাতে বাড়ির হেঁসেলে করলাম প্রত্যাবর্তন। 


বাবা ছিলেন চরম সংস্কৃতিমনা মানুষ। ছিলেন নজরুলগীতি আর রবীন্দ্রসংগীতের ক্লাসিকাল সিঙ্গার। কবিতা ও ছোটগল্পও লিখেছেন প্রচুর। এগুলো ছাপার মুখ দেখেনি নিজের খেয়ালিপনায়। মা অভাবের দোহাই দিয়ে সবগুলো পান্ডুলিপি ছিঁড়ে পেছনের পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিলেন। বাবা এতো সাধের লেখার জলাঞ্জলিতে মায়ের উপর একটুও ক্ষুব্ধ হলেন না। 


বাবার হাতে যেমন দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য একসময় ছিল অসি, পরে হাতে তুলে নিয়েছিলেন মসি। অসির ফল জাতি ভোগ করলেও মসির ফল থেকে জাতি হলো বঞ্চিত। ঠিক তেমনি বাবার পদাঙ্ক আমিও অনুসরণ করলাম। তবে বাবার সাথে কিছুটা পার্থক্য সৃষ্টি হলো। আমিও সমাজের অন্যায়-অবিচার রুখতে হাতে নিয়েছিলাম অসি, কিন্তু তেমন একটা ফল সমাজ পায়নি। 


শেষতক অসি ফেলে ধরলাম মসি। মসির কিছু ফল সৃষ্টি হলেও সেই যে সততার কারণে দৈন্য পেয়ে বসলো, তাই ফলগুলো জাতির সামনে উপস্থাপন করতে খেতে হচ্ছে হিমশিম। নিজের একেবারে কাছের মানুষগুলোও স্বার্থপরের মতো দূরে দূরে থাকছে, না জানি কারও কাছে যদি হাত পেতে বসি, এই আশঙ্কায় । এখন একমাত্র ঈশ্বরই সহায়। হার মানিনি কখনও, মানবোও না, যায় যাবে শির টুটি। জীবন সায়াহ্নেও রইবো অটল। 


নীরব চাকলাদার

মন্তব্য করুন:

Post Bottom Ad
Sidebar Top Ad
Sidebar Botttom Ad