পাদুকা সমাচার
Post Top Ad

পাদুকা সমাচার

১৭/০৭/২০২৫ ০৩:২৫:৫৯

প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না: ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

জুতা বা পাদুকা—এ শব্দটার সঙ্গে আমার আত্মীয়তা অনেক পুরোনো। শৈশবে “জুতা আবিষ্কার” কবিতা পড়েই তার প্রতি একধরনের টান তৈরি হয়েছিল। আমি তখন গ্রামের ছেলে, আর আমাদের গ্রাম তখনও সড়ক দেখেনি। স্কুলে যেতাম চপ্পল পায়ে। তবে একটা জোড়া ‘ভালো জুতা’ ছিল বটে—যেটা আত্মীয়বাড়ি যাওয়ার সময় পায়ে নয়, হাতে বহন করে মূল রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যেতে হতো। তারপর কলের জলে পা ধুয়ে, দুই পায়ে পাদুকা তুলে নিজেকে ভদ্র সমাজের উপযুক্ত করে তোলা হতো।


পাদুকা নিয়ে আমার কৌতূহলের শেষ নেই। আমেরিকায় এসে একবার বিক্রয়কেন্দ্রিক এক মোটিভেশনাল সেমিনারে শুনলাম—আফ্রিকায় দুই বিক্রয় প্রতিনিধি পাঠানো হয়েছিল জুতার বাজার যাচাই করতে। একজন জানাল—“ওখানে তো কেউ জুতা পরে না, বাণিজ্য অসম্ভব!” আরেকজন বললেন—“এটা তো সুবর্ণ সুযোগ, সবাইকে জুতা পরানো যাবে!” দ্বিতীয়জনই পরে এক জুতা কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হয়ে উঠেছিলেন।

পাদুকার চোখে পৃথিবী বড়ই সম্ভাবনাময়!


তবে আমার আসল পাদুকা-গল্প আরও আগে, বাবার মুখে শোনা।


বৃটিশ ভারতে আমাদের এলাকায় যখন প্রথম বাস চলাচল শুরু করে, তখন দিনের পর দিন লোক বসে থাকতো সড়কের পাশে, শুধু একবার সেই চাকার উপর ধাতব বাক্সটিকে দেখতে। পরে এই বাসগুলোকেই আমরা ডাকতাম—‘মুড়ির টিন’।


সে সময় আমার দাদী—গ্রামের ভাষায় ‘বিবি সাহেবা’—একদিন শহরে ডাক্তার দেখাতে রওনা দিলেন। পালকিতে চড়ে নদী পেরিয়ে, গাড়ির রাস্তা পর্যন্ত তাঁকে আনা হলো। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছেলে—অর্থাৎ আমার বাবা, আর ফিরোজ মিয়ার বৌ। বাকিরা নৌকায়।


সব ঠিকঠাক চলছিল। কদমতলীতে গিয়ে গাড়ি থামে। দাদী নামবেন। হঠাৎ বললেন—“আমার জুতা কই?”


দেখা গেল, তিনি পাদুকা খুলে গাড়িতে উঠেছিলেন—বিলাতি গাড়ির ভিতর জুতা পায়ে ওঠা যে বেয়াদবি! কিন্তু কেউই পাদুকাদ্বয় তুলে আনেনি। ফলাফল, শহরের মাঝখানে দাদী দাঁড়িয়ে—পা খালি আর মুখ গম্ভীর।


এরপর কী হয়েছিল, সেটা বাবা আর বলেননি। মায়ের সম্মান রক্ষার্থে গল্পটা সেপর্যন্তই সবসময়য় থেমে গেছে।


আমার জন্য পাদুকার গল্প থেমে থাকেনি অবশ্য। পরে যখন ফিলিপাইনের প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি ইমেলদা মার্কোসের হাজার হাজার জুতা আবিষ্কৃত হলো, তখন সেটা নিয়ে আমাদের ঘরেও বিস্তর আলোচনা হলো। মনে হচ্ছিল, পুরো জাতি যেন হঠাৎ ‘পাদুকা বিশারদ’ হয়ে উঠেছে।


ইমেলদার দস্যু স্বামীর শাসনামলে লুটের টাকায় কেনা সেই বিপুলসংখ্যক জুতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে হইচই পড়ে যায়। আমরা তখন বক্তৃতা দিয়েছি, সংবাদপত্রে বিশ্লেষণ করেছি, মনে হতো— জুতার সমাহার দিয়ে রাষ্ট্র গঠনের তত্ত্ব বুঝি এখনই তৈরি হবে!

আজ হয়তো ইমেলদা মার্কোস তাঁর নব্বই পেরিয়ে ম্যানিলার বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে বসে সেই জুতোগুলোর হিসেব নিয়ে হাসেন, বা হয়তো ভুলেই গেছেন, কোনটা কবে কিনেছিলেন।

তবে ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়— জুতা যে কাউকে বিখ্যাত করে তুলতে পারে!

আজকাল অবশ্য রাষ্ট্রের লুট করা অর্থ দিয়ে জুতা নয়, লুটেরাদের বেগমরা এপার্টম্যান্ট কিনে থাকেন দেশে দেশে।

এইসব স্মৃতি হঠাৎ ফিরে এলো গত সন্ধ্যায়, সামিনের বিয়েতে। কণে দেখার আয়োজন চলছে। ঘরের প্রবেশপথে দেখি বিশাল এক পাদুকা-পাহাড়—নানা রঙের, নানা ব্র্যান্ডের, এমনকি কিছু অচেনা জোড়াও সেখানে ঘুমোচ্ছে।


আমি দাঁড়িয়ে, নিজের জোড়াটা খুঁজছি। কনে দেখতে গিয়ে, নিজে কিছুক্ষণের জন্য জুতাহীন হয়ে পড়েছিলাম। মুহুর্তেই জুতো বিষয়ক সব গল্প মনে আসছিল। একবার লন্ডনে গিয়ে পার্টি করে ঘরে ফরে দেখি। এক পায়ে নিজের কালো রঙের জুতো, অন্য পায়ে বাদামী রঙের জুতো। বেশ বিব্রতও হয়েছিলাম।


পাদুকার গল্প তাই ফুরোয় না। কখনো তা ইতিহাস, কখনো কৌতুক, কখনো স্মৃতি—আর মাঝে মাঝে হয়তো আমাদের পায়ের নিচে থাকা এক নিঃশব্দ অহংকার।


লেখক : সম্পাদক, প্রথম আলো, উত্তর আমেরিকা

মীর্জা ইকবাল

মন্তব্য করুন:

Post Bottom Ad
Sidebar Top Ad
Sidebar Botttom Ad