'সভ্যতা বেয়াদবি পছন্দ করে না'

আমাদের দেশের গ্রামে একবার বিরাট কাণ্ড ঘটেছিল। ফুটবল খেলা নিয়ে দুই গ্রামের মহা-মারামারি। পাশের গ্রামের সাথে খেলা। উত্তেজনায় গরম মাঠ, গরম দর্শক। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না।
আমার আজাদ চাচা তো আগুন ধরিয়ে দিলেন। খেলার মাঝখানে একের পর এক ফাউল করছিলেন। তাঁর সঙ্গী ভেলাই মিয়া, আসাব উদ্দিন—তারা খেলা খেলছিলেন না, যেন ঝগড়া করতে নেমেছিলেন। নিজ চোখে সব দেখলাম।
খেলা ভেঙে গেলো। দুই গ্রামে শুরু হলো যুদ্ধের প্রস্তুতি। লাঠি, তীর, ধনুক, বাঁশ—সব বের হলো। রাতভর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। থানায় খবর যাবে—এমন সাহস কার? সেই সময় থানায় মোটে ১১ জন পুলিশ। তারা কি গ্রামে ঢুকবে, নাকি গ্রামই থানায় চলে যাবে—এই চিন্তায় পুলিশরাও নিশ্চুপ।
আমাদের গ্রামের লোকজন জোরালো। হুঙ্কার বেশি, সাহস বেশি। সারা রাত জেগে থাকলাম, উত্তেজনায়। ভোরে খবর আসলো—সন্ধি হয়ে গেছে! দুই গ্রামের 'মাতবররা' সালিশ করবেন। আমি তো হতাশ! উত্তেজনা এমন হুট করে ফুরিয়ে গেলো?
আমাদের গ্রামের 'মাতবর' তৈয়ব আলী, কুমুদ বিশ্বাস, সুলতান আলী—এরা প্রায় নিরক্ষর ছিলেন। কিন্তু যখন সালিশে বসতেন, মনে হতো গ্রিক দার্শনিকদেরও হার মানাবেন। কথা বলেন টান দিয়ে, যুক্তি দেন শান দিয়ে।
আমার গ্রাম্য বন্ধু ফয়জুর রহমান, উত্তেজনার পাগল। মনমরা হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, উত্তেজনা কি শেষ!
ঠিক তখনই পাশের গ্রাম থেকে দুজন দূত এলেন। সালাম দিয়ে বললেন—"পরের শুক্রবার, অমুক গ্রামের স্কুলে সালিশ। এ গ্রাম থেকে ১০ জন, তাদের গ্রাম থেকেও ১০ জন থাকবেন।"
আজাদ চাচার মুখ গোমড়া। সালিশ মানে ন্যায়-অন্যায় দেখা হবে। উত্তেজনার মাঠ ফাঁকা! আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলেন। ফয়জুর রহমানের টিপ্পনি —"ব্যবস্থা একটা অইবো, ই বিচার বইলেই আমাদের নতিজা খারাপ!"
হঠাৎ দেখি, মাতবর তৈয়ব আলী গর্জে উঠলেন।
"এইটা কেমন কথা? সালিশ আমাদের সাথে। তারাই দিন, তারিখ, সময় ঠিক করে আমাদের জানাচ্ছে? তারা কারা? বেয়াদবি করে কথা বলছে। আগে আমাদের কাছে দিন-তারিখ চাইবে। বেয়াদবরা দিন, তারিখ, স্থান ঠিক করে আমাদের ডাকবে, এইটা কেমন নিয়ম?"
ফয়জুর রহমান ফিসফিস আজও কানে বাজে —"কাম অই গেছে! উত্তেজনা আবার জ্বলে উঠছে!"
মুল খেলার মারামারির বাইরে, এরপর আরও সপ্তাহখানেক উত্তেজনা চলেছিল শুধু এই প্রশ্ন নিয়ে— বেয়াদবি হইছে, না হয় নাই?
অনেক পথ পেরিয়ে আমি এখন আমেরিকায় থাকি। এখানেও দেখেছি— সভ্য সমাজ স্পষ্ট কথা পছন্দ করে, কিন্তু বেয়াদবি একটুও সহ্য করে না। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রও তো স্পষ্ট কথা বলেছিলেন। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু কখনও বেয়াদবি করেননি। তাঁর শান্ত, ভদ্র ভাষায় ছিল শক্তি। তাই আজও মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
সত্য বলো, স্পষ্ট কথা বলো—কিন্তু সম্মান রেখে বলো। উত্তেজনা ভালো, বেয়াদবি নয়।
লেখক
ইব্রাহিম চৌধুরী
সম্পাদক
প্রথম আলো
উত্তর আমেরিকা
নীরব চাকলাদার

মন্তব্য করুন: